আব্বাসাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ও জাফর হত্যার রহস্যের খোজে

( আব্বাসা। খলীফা হারুনুর রশিদের বোন। তাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। বলা হয় তার সাথে উযির জাফর বারমাকির প্রনয় ছিল। জাফরের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। শর্ত ছিল তারা যৌন সম্পর্ক করতে পারবে না।

কিন্তু তারা যৌন সম্পর্ক করে এবং তাদের একটি সন্তান হয়। ফলে খলীফা ক্রুদ্ধ হয়ে জাফরকে হত্যা করেন। জাফরকে হত্যা করা হয়েছে আব্বাসার কারনেই। এই গল্পের সত্যমিথ্যা কতটুকু ? আসলেই কি আব্বাসার সাথে জাফরের বিয়ে হয়েছে ? জাফরকে হত্যার প্রকৃত কারনই বা কী ? কী বলছে ইতিহাস গ্রন্থগুলো? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়েই এই লেখা)

বারামেকা পরিবার
বারামেকা পরিবার। আব্বাসী সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলোচনায় যাদের কথা বলতেই হয়। আব্বাসী সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে প্রায় পঞ্চাশ বছর (১৩৬ হিজরী-১৮৭ হিজরী) এই পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত সুনাম ও খ্যাতির সাথে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। বলতে গেলে সাম্রাজ্য পরিচালনার চাবিকাঠি ছিল তাদের হাতেই। তাদের হাতেই বাগদাদ হয়ে উঠে সুশোভিত। বারামেকাদের স্বর্নযুগ ধরা যায় হারুনুর রশিদের শাসনামল। আবার তাদের পতনও হয় হারুনের হাতেই। বারামেকাদের আদী বাসস্থান ছিল বলখে। সেখানে এক বিশাল অগ্নিকুন্ড ছিল। স্থানীয়রা এই অগ্নিকুন্ডের উপাসনা করতো । ৩১ হিজরীতে (৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) মুসলমানদের হাতে বলখ বিজয়ের পর অগ্নিকুন্ড নিভিয়ে ফেলা হয়। কিছুকাল পরে আবার এই অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হয়। ৮৬ হিজরীতে (৭০৫খ্রিস্টাব্দ) কুতাইবা বিন মুসলিম আবারো বলখ দখল করেন এবং একে ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই সময় অগ্নিপূজকদের একটি অংশ ইসলাম গ্রহণ করে দামেশকে চলে যায়। ১৩৩ হিজরীতে যখন দারুল খিলাফাহ দামেশক থেকে বাগদাদে সরিয়ে নেয়া হয় তখন তারাও বাগদাদ গমন করে।। এ সময় থেকে রাজদরবারে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। অগ্নিপূজক এই সম্প্রদায়ের নাম ছিল বারমাক। বারমাকের বহুবচন বারামেকা। খালেদ বারমাকি, ইয়াহইয়া বারমাকি, জাফর বারমাকি, ফজল বারমাকি এই পরিবারের গ্রুত্বপূর্ন ব্যক্তিত্ব। বারমাকিরা আব্বাসি সাম্রাজ্যের উন্নয়নে নানা ধরনের অবদান রেখেছে। বিশেষ করে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার প্রসারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইয়াহইয়া বারমাকি ভারতবর্ষে দূত প্রেরন করে এখানকার বেশকজন পন্ডীতকে বাগদাদ নিয়ে যান। তিনি অনুবাদক নিয়োগ করে ভারতবর্ষে রচিত চিকিতসাশাস্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বেশকিছু বই অনুবাদ করান। (১)

ইয়াহইয়া বারমাকি বাগদাদে ইলমী বিতর্কের আয়োজন করতেন। পরে খলীফা মামুনের আমলে এর আরো বিস্তৃতি লাভ করে। প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি সাহিত্য ও কাব্যরচনায় বারামেকাদের পারদর্শীতা ছিল। ফজল বারমাকি বাগদাদে কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। (২)

প্রশাসনিক পদোন্নতি ও খলিফার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারনে বারামেকারা বিপুল অর্থবৈভব ও প্রভাব প্রতিপত্তির মালিক হয়। বাগদাদের আবাদী জমির বেশিরভাগ তাদের দখলে চলে যায়। এসময় তারাই পর্দার আড়াল থেকে হয়ে উঠে খেলাফতের নিয়ন্ত্রক। প্রকাশ পেতে থাকে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা। গুরুত্বপুর্ণ পদ্গুলো তাদের দখলে চলে আসে। ইবনে খালদুনের মতে , তারা কোষাগারের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। অনেকসময় খলিফা হারুনুর রশিদ প্রয়োজনে পড়ে কোষাধ্যক্ষের কাছে অর্থ চেয়েও পেতেন না। (৩)
নানাকারনে বারামেকাদের অনেক শত্রু তৈরী হয়। এদের একজন খলীফা হারুনুর রশিদের প্রাসাদের প্রধান পাহারাদার (হাজেব) ফজল ইবনে রবী। ফজল তার পদমর্যাদাবলে খলীফার কাছে বারামেকাদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেন। তার মনকে বিষিয়ে তোলেন। খলিফাকে বলা হয় বারামেকারা বনু আব্বাসের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে। ফজল ইবনে রবির অভিযোগ ও ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারনে খলিফা বারামেকাদের উপর ক্রুদ্ধ হন। ১৮৭ হিজরীর (৮০৩ খ্রিস্টাব্দ) একরাতে খলীফা আদেশ দিলেন উযির জাফরকে হত্যা এবং জাফরের পিতা ইয়াহইয়া ও ভাই ফজলকে গ্রেফতার করতে। একইসাথে বারামেকাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেয়া হলো। খলিফার অনুচর মাসরুরের মাধ্যমে জাফরের হত্যাকান্ড সম্পন্ন হলো। বারামেকাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। ইয়াহইয়া বারমাকি ও অন্যদের রাক্কা শহরে বন্দী করা হয়। প্রথম এক বছর তাদেরকে কোনো কষ্ট দেয়া হয় নি। তাদের সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের দিকেও খেয়াল রাখা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে আব্দুল মালিক ইবনে সালেহ ও তার পুত্র খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার হন। অভিযোগ উঠে বারামেকারা এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত ছিল। এবার খলিফা বন্দী বারামেকাদের উপর ক্রুদ্ধ হন এবং সকল সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেন। ১৯০ হিজরীতে বৃদ্ধ ইয়াহইয়া বারমাকি কারাগারে মৃত্যুবরন করেন। মামুন ক্ষমতায় এলে বারামেকাদের মুক্তি দেন এবং তাদের সম্পদও ফিরিয়ে দেন। (৪) কিন্তু বারামেকারা আর তাদের হারানো জৌলুস ফিরে পায় নি।

সাইয়েদ সোলাইমান নদভীর মতে, খলীফা হারুনুর রশিদ যদি বারামেকাদের উপর খড়গহস্ত না হতেন , তাহলে হয়তো আব্বাসী সাম্রাজ্যের ইতিহাসই বদলে যেত। (৫)

জাফর বারমাকি
ইয়াহইয়া বারমাকির ছেলে জাফর বারমাকির জন্ম ১৫১ হিজরীতে (৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। খলিফা আবু জাফর মানসুরের শাসনকালে। বাল্যকালেই জাফরের জন্য বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। জাফর ফিকহ পড়েন কাজি আবু ইউসুফের কাছে। আবু ইউসুফ ছিলেন নানা শাস্ত্রে দক্ষ। শিক্ষাজীবন শেষে জাফর সাহিত্য, ফিকহ, দর্শন ও জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষ হয়ে উঠেন। মুহাম্মদ বিন রাশেদ ইসহাক মসুলির বর্ননামতে, জাফর বাগদাদের আলেমদের অন্যতম ছিলেন। প্রশাসনিক কাজে জাফর কখন নিযুক্ত হন তার কোনো বিশুদ্ধ বর্ননা পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে এটা বুঝা যায়, হারুনুর রশিদ খলিফা হওয়ার এক বছর পর জাফরকে উযির নিযুক্ত করেন। ১৭৫ হিজরীতে (৭৯১ খ্রিস্টাব্দ) জাফরকে মিসরের শাসক নিযুক্ত করা হয়।

১৭৭ হিজরীতে (৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ) তার পরিবর্তে ইসহাক বিন সুলাইমান কে পাঠানো হয়। ১৮০ হিজরীতে জাফরকে পাঠানো হয় শামের বিদ্রোহ দমন করতে। কিছুকাল তাকে খোরাসান ও সিজিস্তানে পাঠানো হয়। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন। খলিফার সাথে তার অত্যন্ত ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। জাফরের পিতা ইয়াহইয়া ছিলেন হারুনের শিক্ষক। খলীফা নিজের যে কোনো কাজে জাফরকে সাথে রাখতেন। নিজের জন্য যা পছন্দ করতেন জাফরের জন্যও তা পছন্দ করতেন। প্রায়ই তাকে ভাই বলে ডাকতেন। উযির হিসেবে জাফর ছিলেন দুরদর্শী, বিচক্ষণ ও কৌশলী। (৬)

জাফর হত্যার স্বরুপ সন্ধান
জাফরকে হত্যা করা হয় ১৮৭ হিজরীতে। পুরো ব্যপারটিই ছিল আকস্মিক। এমনকি হত্যার দিনে সারাদিন খলিফা জাফরকে নিজের সাথে রেখেছেন। শেষ বিকেলে খলীফা বললেন, ‘জাফর,আমি তোমাকে এতটাই ভালোবাসি, আজ তোমার থেকে পৃথক হতে ইচ্ছে করছে না। যদি আজ স্ত্রীর কাছে না যেতাম, তাহলে সারারাত তোমার সাথে গল্প করতাম’ ।সে রাতে খলীফা মাসরুরকে নির্দেশ দিলেন, জাফর বারমাকিকে হত্যা করো। ইয়াহইয়া বারমাকি ও ফজল বারমাকিকে গ্রেফতার করো। একইসাথে বারমাকিদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করো। (৭)

খলীফার আদেশমতে সেরাতেই জাফরকে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিকরা এ হত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বক্ষমান আলোচনায় পুরো ঘটনার বিবরণ দেয়ার সুযোগ নেই। আমরা আপাতত এ হত্যাকান্ডের কারন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বর্ননা তুলে ধরবো।

ইবনে খালদুন লিখেছেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা বারামেকাদের হাতে চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই খলিফা কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন। এছাড়া বারামেকাদের বিরোধী পক্ষ তাদের ব্যাপারে খলিফার কান ভারী করতে থাকে। ফলে জাফরের ছোট ছোট দোষও খলিফার চোখে বড় হয়ে দেখা দেয়। একারনে খলিফা জাফর ও তার পরিবারের উপর রুষ্ট হন (৮) অন্যত্র তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বারামেকাদের পতনের যথার্থ কারন তাদের অযথা হস্তক্ষেপের মধ্যে নিহিত ছিল। (৯)

ইবনে কাসীর এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বর্ননা এনেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, খলিফা জাফরকে বলেছিলেন, ইয়াহইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসানকে নিজের ঘরে বন্দী রাখতে। জাফর তাকে মুক্ত করে দেয়। খলীফা প্রথমে এই সংবাদ বিশ্বাস করেন নি। পরে জাফর স্বীকার করলে খলীফা ক্রুদ্ধ হন এবং তিনি কসম খেয়ে বলেন, জাফরকে আমি অবশ্যই হত্যা করবো। খলীফা জাফরের উপর আরো কয়েকটি কারনে ক্রুদ্ধ হন। তিনি যে এলাকায় যেতেন দেখতেন সেখানের সব ভালো জমি জাফরের দখলে। এছাড়া জাফর প্রচুর অর্থব্যায়ে একটি ঘর নির্মাণ করে। এতেও খলিফা রাগান্বিত হন। (১০)

ইবনে আসীর জাফরের নির্মিত বিলাসবহুল গৃহের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরেকটি বর্ননা এনেছেন, তা হলো, একদিন ইয়াহইয়া বারমাকি খলিফার বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করে। খলিফা তখন সামনে উপবিষ্ট শাহী চিকিতসককে বলেন, তোমাদের এলাকায় কি লোকজন অনুমতি ছাড়া ঘরে চলে আসে ? এ কথা শুনে ইয়াহইয়া লজ্জিত হন। মূলত এ সময় থেকেই খলিফা বারামেকাদের উপর ক্ষিপ্ত হতে শুরু করেন। ইবনে আসীর এ হত্যাকান্ডের কারন হিসেবে তাবারীর বর্ননাটিও উল্লেখ করেছেন, যা থেকে আব্বসাকে নিয়ে বিভ্রান্তির সূচনা। (১১)

হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাভী জাফরের ঘর নির্মাণের বর্ননা বেশ গুরত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি বারামেকাদের উপর সুলতানের ক্ষিপ্ত হওয়ার আরেকটি কারন বর্ননা করেছেন। ইয়াহইয়া বারমাকি দরবারে প্রবেশ করলে গিলমানরা তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতো। বিষয়টি খলিফা অপছন্দ করেন। তিনি মাসরুরকে আদেশ দেন, গিলমানদের সম্মান জানাতে নিষেধ করতে। হাফেজ জাহাভীও অন্যান্য বর্ননার সাথে তাবারীর বর্ননাটি এনেছেন। (১২)

ইবনে খাল্লিকান উপরোক্ত কারনসমূহ উল্লেখের পাশাপাশি তাবারীর ভিত্তিহীন বর্ননাটিও এনেছেন।(১৩)

ইবনুল জাওযি ইয়াহইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসানের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি আবু বকর সুলির একটি বর্ননা এনেছেন। সুলি বলেন খলিফার বোন আলিয়া তাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনি কেন জাফরকে হত্যা করেছেন। খলিফা জবাব দিলেন, যদি আমি টের পাই আমার জামা এই হত্যার কারন জানে তাহলে আমি জামাকেও পুড়িয়ে ফেলবো। ইবনুল জাওযি বিস্ময়ের সাথে তাবারির বর্ননাটিও উল্লেখ করেছেন। (১৪)

মুহম্মদ রেজা-ই-করীম লিখেছেন, সম্ভবত আব্বাসীয় দরবারে বারমাকিদের ইরানি প্রভাব আরব সভাসদবর্গের ঈর্ষার কারণ হইয়া দাড়াইয়াছিল এবং উহা হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য তাহারা খলিফাকে কুমন্ত্রণা দিয়াছিল । (১৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইবনে খালদুনের বক্তব্যই শক্তিশালী মনে হয়। বারামেকাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও অন্যায় হস্তক্ষেপ খলিফাকে বিষিয়ে তোলে।

তাবারীর বর্ননায় কী আছে?
জাফরের হত্যাকান্ডের সাথে আব্বাসাকে জড়িয়ে যে গল্প চালু হয়েছে তার মূল উৎস ইবনে জারির তাবারির একটি বর্ননা। যারাই জাফরের হত্যাকান্ডের সাথে আব্বাসাকে জড়িয়েছেন সবাই এই বর্ননা থেকেই রসদ নিয়েছেন। পরে গল্প উপন্যাসের কল্যানে এই গল্প ডালপালা মেলেছে। চালু হয়েছে নানা কিসিমের মুখরোচক গল্প। দেখা যাক, তাবারীর বর্ননায় কী আছে?
তারীখে তাবারীতে বারামেকাদের পতনের কারন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তাবারি বর্ননা করেন,
আমাকে যুহাইর বর্ননা করেছেন, তাকে তার চাচা যহির বিন হারব বলেছেন, বারামেকাদের পতনের জন্য জাফর ও আব্বাসার বিবাহ দায়ি। খলিফা হারুনুর রশিদ , জাফর ও আব্বাসা দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন। তাদেরকে দেখা ছাড়া থাকতে পারতেন না। খলিফা চাইতেন মদপানের মজলিসে দুজনই উপস্থিত থাকুক। এজন্য খলিফা জাফরকে বললেন, তুমি আব্বাসাকে বিবাহ করো। তাহলে আর পর্দার সমস্যা হবে না। তবে তার সাথে যৌন সম্পর্ক করতে পারবে না। এই শর্তে খলিফা জাফরের সাথে আব্বাসার বিবাহ দেন। পরে মদ্যপ অবস্থায় জাফর আব্বাসার সাথে যৌন সম্পর্ক করে এবং তাদের একটি সন্তান হয়। এ সংবাদ খলিফা থেকে গোপন করে শিশুটিকে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আব্বাসার সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে জনৈক দাসি একথা খলিফাকে জানিয়ে দেয়। খলিফা সেবছর হজ্বের সফরে শিশুটির ব্যাপারে নিশ্চিত হন। তিনি শিশুটিকে হত্যা করেন এবং জাফরকেও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন(১৬)

তাবারির বর্ননা এটুকুই। আব্বাসাকে নিয়ে বিভ্রান্তির শুরুও এখান থেকেই। অথচ তাবারী স্বীয় অভ্যাসমতে অন্যান্য বর্ননার সাথে এটিকেও এনেছেন এবং কোনোটিকেই তিনি তারজিহ বা প্রাধান্য দেন নি। তবে তাবারির পরে অন্যান্যরা এ গল্পকে আরো বড় করেছেন। রঙ চড়িয়েছেন। বিশেষ করে ঐতিহাসিক মাসউদি মারুজুজ জাহাব গ্রন্থে এক দীর্ঘ গল্প এনেছেন। সেসব দীর্ঘ গল্পের দিকে না গিয়ে সরাসরি তাবারির বর্ননা নিয়েই আলোচনা করা যাক।

প্রথমদিকের ঐতিহাসিকদের মধ্যে তাবারী উল্লেখযোগ্য। তার রচিত ইতিহাসগ্রন্থটিও আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তবে তাবারীর সব বর্ননাই নির্ভুল কিংবা গ্রহনযোগ্য বিষয়টা এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি লোকমুখে শ্রুত ও প্রচলিত অনেক ঘটনাও উল্লেখ করেছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। এসব বর্ননা তিনি উল্লেখ করেছেন অন্যান্য বর্ননার পাশাপাশি, এবং এগুলোর কোনো একটিকে প্রাধান্য দেয়া ব্যতিতই। শুধু তাবারী একা নন, ঐতিহাসিকদের অনেকেই এমনকিছু ভিত্তিহীন বর্ননা এনেছেন , যার দ্বারা পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে অনেক ভিত্তিহীন গল্প। কাজি ইয়াহইয়া ইবনে আকসামের মদপান, মামুনের প্রেমের গল্প, এসব এমনই ভিত্তিহীন গল্পের অংশ। ইবনে খালদুন এ ব্যাপারে বলেন, ঐতিহাসিকদের অনেকেই কল্পিত বর্ননা ও মিথ্যা কাহিনীর সংযোজন করেছেন। পরে অনেকেই এগুলো অক্ষুন্ন রেখেছেন এবং এই অতিরঞ্জিত বিবরণই আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। এখানে অনুসন্ধানের চেষ্টা নেই। বিচার বিশ্লেষন করে ঘটনাবলীকে কলুষমুক্ত করার চেষ্টা নেই। (১৭)

তাবারীর বর্ননার দূর্বলতা
১। তাবারীর বর্ননায় যুহাইর ও তার চাচা যাহের আছেন। এই দুজন মুতাজিলী ছিল। তাদের কেউই জাফরের হত্যাকান্ডের সময় উপস্থিত ছিল না। তাবারী নিজেই জাফরের হত্যাকান্ডে জড়িতদের নামের তালিকা দিয়েছেন সেখানে এই দুজনের নাম নেই। এছাড়া অন্য ঐতিহাসিকরাও এ দুজনের নাম দেন নি। সর্বশেষ বর্ননাকারী যাহের নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না।

২। হারুনুর রশিদের নামে মদপানের যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা রীতিমত বিস্ময়কর ও ভিত্তিহীন। ইবনে খালদুন আফসোস করে লিখেছেন, ঐতিহাসিকগন সম্রাট হারুনের সুরাসক্তি ও অন্তরংগদের সাথে সুরাপানের আসর বসানোর যে অবমাননার কাহিনি বর্ননা করেছেন, আল্লাহ ক্ষমা করুন, তার সম্পর্কে অনুরুপ দুর্মতির কোনো জ্ঞানই আমাদের নেই। খেলাফতের উত্তরসূরী, ধর্ম ও ন্যায়পরায়নতার প্রতিভূ সম্রাট হারুনের পক্ষে এটা কীভাবেই বা সম্ভব । তিনি সর্বদা জ্ঞানীগুনি ও আধ্যাত্মিক মনিষীদের সাহচর্যে থাকতেন। ফুজাইল ইবনে আয়াজ, ইবনে সামাক, উমরির ন্যায় গুনিদের সাথে আলচনা করতেন। সুফিয়ান সাউরির ন্যায় মনিষীর সাথে তার পত্রালাপ চলতো। (১৮) মদের ব্যাপারে খলিফার অনাসক্তি বুঝতে এটাই যথেষ্ট যে, খলীফা মদপানের কারনে কবি আবু নাওয়াসকে গ্রেফতার করেন এবং মদপান ত্যাগ করার আগে তাকে মুক্তি দেয়া হয় নি। অবশ্য খলিফা আঙ্গুরের রস পান করতেন। কিন্তু একে মদ বলা ভুল। খলিফা মদের আসর বসাতেন এর কোনো বিশ্বস্ত বর্ননা পাওয়া যায় না। যেখানে মদের আসরই প্রমানিত নয় সেখানে শুধু এই আসরের জন্যই জাফর ও আব্বাসার বিবাহের গল্প কীভাবে সত্য হতে পারে।

৩। বারামেকাদের পতনের পর আবু নাওয়াস ও অন্যান্য কবিরা যেসকল কবিতা রচনা করেছেন, তাতে এই বিবাহের কোনো আভাসও নেই। তাবারী ছাড়া আর কারো কাছেই যেন এ বিবাহের সংবাদ পৌছে নি।
৪। হারুনুর রশীদ একজন আব্বাসী। তিনি কী করে তার বোনকে অনারব মুক্ত ক্রীতদাসের সাথে বিবাহ দিবেন? ইবনে খালদুন তাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, জাফর ইবনে ইয়াহইয়ার সাথে আব্বাসার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন কী করে সম্ভব হতে পারে? একজনের পূর্বপুরুষ রাসুলের (সা) পিতৃব্য ও কোরায়শ বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আর অন্যজনের পিতৃব্য অনারব পারস্যবাসী। আব্বাসিয়রাই বারমাকিদের ক্রীতদাসের কলংক থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করেন। চিন্তাশীল পাঠক যদি বিষয়টি নিয়ে ভাবেন তাহলে তার বিবেক কিছুতেই এই কথা সমর্থন করবে না যে, আব্বাসা নিজ বংশের দ্বারা মুক্তিপ্রাপ্ত একজনের সাথে এ প্রকার সম্পর্কে রাজী হবেন। (১৯)

৫। আব্বাসার বিয়ে সম্পর্কে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও গ্রহনযোগ্য বক্তব্য দিয়েছেন আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম ইবনে কুতাইবা দিনাওয়ারি। তার জন্ম ২১৩ হিজরীতে । অর্থাৎ, জাফরের হত্যাকান্ডের ২৬ বছর পরে। জীবনের এক দীর্ঘ সময় তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন। সেসময় বাগদাদে বারমাকিদের অনেকেই বেচে ছিল যারা জাফর হত্যাকান্ডের পূর্বাপর জানতো। যদি বারমাকিরা জাফর হত্যার জন্য আব্বাসার সাথে জাফরের বিবাহের গল্প বলতো তাহলে আবু আবদুল্লাহ অবশ্যই সে তথ্য উল্লেখ করতেন। কিন্তু আব্বাসা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, আব্বাসার প্রথম বিবাহ হয় মুহাম্মদ বিন সোলায়মান বিন আলি বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে। মুহাম্মদ মারা গেলে পরে ইবরাহীম বিন সালেহ বিন আলি বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। (২০)

আব্বাসার জন্ম হয় ১৫৪ হিজরীতে, কুফায়। ১৭২ হিজরীতে মুহাম্মদ বিন সোলায়মানের সাথে তার বিয়ে হয়। মুহাম্মদ বিন সোলায়মান ছিলেন বসরার গভর্ণর। ১৭৪ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে আব্বাসার বিয়ে হয় ইবরাহীম বিন সালেহর সাথে। আবু আব্দুল্লাহ দিনাওয়ারি ছাড়াও এই বিয়ের উল্লেখ করেছেন সালেহ হিন্দী। তিনি হারুনুর রশীদের রাজ চিকিতসক ছিলেন। একবার ইবরাহিম বিন সালেহ প্রচন্ড অসুস্থ হলে তিনি চিকিতসা করেন। ইবরাহিম সুস্থ হলে আব্বাসার সাথে তার বিয়ে হয়। সময়কাল ১৭৬ হিজরী। (২১) ইবরাহীমকে মিসরের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। তিনি ও আব্বাসা মিসরেই ইন্তেকাল করেন। (২২)
৬। খলিফা আব্বাসাকে সারাক্ষন নিজের কাছে রাখতে চাইতেন এই গল্পও নাকচ হয়ে যায়। কারন আব্বাসা প্রথম বিবাহের পর বসরা এবং দ্বিতীয় বিবাহের পর মিসরে চলে যান।

(প্রখ্যাত উর্দু উপন্যাসিক সাদিক হোসাইন সিদ্দিকী তার রচিত ‘শাহজাদী আব্বাসা’ গ্রন্থে বেশ জোরের সাথে বলেছেন, প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আব্বাসা আর বিবাহ করেন নি। তবে নির্ভরযোগ্য মত হলো আব্বাসার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল)

তথ্যসূত্র :
১। আরব ও হিন্দ কে তাআল্লুকাত, (৬১-৬৫ পৃষ্ঠা) — সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। মশাল বুকস, লাহোর।
২। আল বারামেকা , (১২৮,১২৯ পৃষ্ঠা) — মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী। নামী প্রেস, কানপুর।
৩। আল মুকাদ্দিমা , (১ম খন্ড,১০০ পৃষ্ঠা) — আল্লামা ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
৪। হিস্ট্রি অব সারাসিনস, (১৭৬,১৭৭ পৃষ্ঠা)– সৈয়দ আমীর আলী। বাংলা সংস্করণ, বাংলা একাডেমী।
৫।আরব ও হিন্দ কে তাআল্লুকাত, ৬৫ পৃষ্ঠা — সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। মশাল বুকস, লাহোর।
৬। আল বারামেকা, (১৪৮-১৫৫ পৃষ্ঠা)– মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী। নামী প্রেস, কানপুর।
৭। কিতাবুল উযারা, (১৫০, ১৫১ পৃষ্ঠা)– আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ জাহশায়ারি। দারুল ফিকরিল হাদিস, বৈরুত।
৮। তারীখে ইবনে খালদুন , (৩য় খন্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা) — আল্লামা ইবনে খালদুন। দারুল ফিকর।
৯। আল মুকাদ্দিমা, (১ম খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা)– ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১০। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (১০ম খন্ড,১৮৯-১৯১ পৃষ্ঠা)— হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির। মাকতাবাতুল মাআরিফ। বৈরুত।
১১। আল কামেল ফিত তারিখ (৫ম খন্ড, ৩২৭-৩৩০ পৃষ্ঠা)– ইবনুল আসির জাযারি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত।
১২। তারীখুল ইসলাম (১২শ খন্ড, ২২-২৭ পৃষ্ঠা)– হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাভী। দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত।
১৩। ওফায়াতুল আইয়ান (১ম খন্ড, ৩২৯,৩৩০ পৃষ্ঠা) –ইবনে খাল্লিকান। দারু সাদের, বৈরুত।
১৪। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম (৯ম খন্ড, ১২৬-১৩৩)– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত।
১৫। আরব জাতীর ইতিহাস (২২৭ পৃষ্ঠা)– মুহম্মদ রেজা-ই-করীম। বাংলা একাডেমী।
১৬। তারীখে তাবারী (৮ম খন্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা)– আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির তাবারী। দারুল মাআরিফ, কায়রো।
১৭। আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ৯৫ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১৮। আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ১০২ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১৯।আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
২০। আল মাআরিফ (৩৯৪ পৃষ্ঠা)– আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ দিনাওয়ারি। উর্দু সংস্করণ। কিরতাস পাবলিকেশন্স, করাচী।
২১। উয়ুনুল আনবা ফি তবাকাতিল আতিব্বা (৩২৪ পৃষ্ঠা)– ইবএন আবি উসাইবা। মাকতাবাতুল হায়াত, বৈরুত।
২২। আল বারামেকা , (২৭৭ পৃষ্ঠা) — মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী।নামী প্রেস, কানপুর।

লেখক: ইমরান রাইহান

অন্যান্য লেখা

১৮৫৭ সালে দিল্লীর প্রতিটি ঘটনাই ছিল মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। তবে শাহজাদাদের নির্মম হত্যাকান্ড অন্যসব ঘটনার নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এমন নয় যে, শাহজাদারা খুবই যোগ্য ছিলেন কিংবা.......
ইবনে নাদীম, বিস্ময়কর আল ফিহরিস্ত বইয়ের লেখক, যার পুরো নাম আবুল ফারাজ মোহাম্মদ বিন ইসহাক আন নাদীম, তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ওয়াররাক। আমাদের পরিচিত আরো অনেকেইওয়াররাক.........
ভারতবর্ষে বরাবরই ইতিহাসচর্চায় আগ্রহ- উদ্দীপনা ছিল। এখানকার লেখকরা তাই রাজন্যবর্গের শাসনকাল ও তাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস সংরক্ষনে কলম ধরেছেন। তারা আলেম, সুফী, কবি,......

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉