সাদ (রা) ইসলামের ঘোষণা দিলে তাঁর মা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “সাদ যতক্ষণ মোহাম্মদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না দেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসব না।” সাদ (রা) বড়ই অস্থির হয়ে পড়লেন। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসলো আসমানী নির্দেশনা, “আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরিক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের মেনো না।” [১] অতঃপর সাদ (রা) মায়ের এ অযৌক্তিক দাবির বিপরীতে দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা করেন, “মা, আপনার মত হাজারটি মাও যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার ব্যাপারে জিদ ধরে পানাহার ছেড়ে দেয় এবং প্রাণ বি স র্জন দেয়, তবুও সত্য দ্বীন পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
সাদ (রা)-এর ইসলামের প্রতি এমন সুকঠিন অবিচলতায় তাঁর মাও বিস্মিত হয়ে যান। সন্তানের মুখে পরম সত্যের আহ্বান শুনে তিনিও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন, আত্মসমর্পণ করেন আল্লাহর অমোঘ বিধানের নিকট। সাদ (রা)-এর পিতাও ইসলাম গ্রহণ করে রাসূল ﷺ-এর সাহাবী হওয়ার মহান সৌভাগ্য অর্জন করেন। তাঁর ভাই উমাইর (রা) রাসূল ﷺ-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির কিছুদিন পরই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বদর যু দ্ধে শ হিদ হন। তাঁর পরিবারের প্রত্যেকেই ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একান্ত আস্থাভাজন।
হিজরতের পরবর্তী বছরে রাসূল ﷺ কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ৬০ জন উষ্ট্রারোহীর একটি দল পাঠান। উভয়পক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে গেলেও কুরাইশদের একজন হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে সাদ (রা) সাথে সাথে তীর নিক্ষেপ করেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে কা ফি রদের প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর। বদর প্রান্তরে, তাঁর দুঃসাহসিক বীরগাঁথা আজও অমলিন রয়েছে। ভাই উমাইর (রা)-কে সাথে নিয়ে একাধিক কা ফি রকে কঠোরভাবে দমন করেন। উহুদের যু দ্ধেও সাদ (রা) কা ফি রদের প্রবল আক্রমণ থেকে রাসূল ﷺ-কে সুরক্ষার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। খন্দকের যু দ্ধের সময় এক হীমশীতল রাতে রাসূল ﷺ-এর নিরাপত্তার জন্য সারারাত একাকী নির্জনে পাহারারত ছিলেন।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর বেশ কিছুকাল ধরে মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। সেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও সাদ (রা) দাওয়াতী কাজ চালু রেখেছিলেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে একের পর এক যু দ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সাদ (রা) বলেন, “আমরা রাসূল ﷺ-এর সাথে যু দ্ধে অংশগ্রহণ করতাম; অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না।” দারিদ্র্য, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন তাঁদের জন্য কখনোই ইসলামের পথে বাঁধা হতে পারেনি। বরং আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতিশ্রুত পুরস্কারের প্রতি আস্থা রেখে দ্বীনের জন্য কাজ করে গিয়েছেন নিবিড়ভাবে।
উমর (রা), তাঁর খিলাফতকালে কিসরা বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুসলিমদের সম্মিলিত ফ্রন্ট তৈরি করেন এবং সাদ (রা)-কে উক্ত ফ্রন্টের সর্বাধিনায়ক করলেন। পথিমধ্যে ইরানীরা তাদের যাত্রা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে নদীর পুল ধ্বংস করে দিলে, তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, “তারা জানে না আল্লাহর উপর ভরসাকারীরা, মানবতার সেবকরা, পুল বা নৌকার উপর ভরসা করে না। আমি পরম দয়ালু-দাতা আল্লাহর নামে আমার ঘোড়াটি নদীতে নামিয়ে দিচ্ছি তোমরা আমার অনুসরণ কর।” জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখতেন। তিনি ছিলেন “মুজতাজাবুদ দাওয়াহ” অর্থাৎ এমন ব্যক্তি যিনি দোয়া করা মাত্রই আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করে নেন। স্বয়ং রাসূল ﷺ তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ, আপনি সাদের দু’আ কবুল করুন, যখন সে দু’আ করবে।”
উসমান (রা)-এর শা হা দাতের পর মুসলিমদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হলে, সাদ (রা) নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকেন। কোন মুসলিমের পক্ষে বা বিপক্ষে ত র বারি উত্তোলনকে বৈধ মনে করেননি। খুলাফায়ে রাশেদীন (ইসলামের প্রথম চারজন খলিফা) ও অন্যান্য সাহাবীদের নিকট সাদ (রা)-এর মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল অতি উচ্চে। উমর (রা) নিজ পুত্রকে বলেছেন, “সাদ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদিস বর্ণনা করে, তখন সে সম্পর্কে অন্য কারও নিকট কিছু জিজ্ঞেস করবে না।” রাসূল ﷺ, বিলাল (রা)-এর অনুপস্থিতিতে সাদ (রা)-কে আজান দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। মৃ ত্যুকালে বহু ধন-সম্পদের অধিকারী হলেও একটি পুরাতন পশমী কাপড় দেখিয়ে বলেছিলেন, “এ দিয়েই আমাকে কাফন দেবে, এ জুব্বা পরেই আমি বদর যু দ্ধে কা ফি রদের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমার ইচ্ছা, এটা নিয়েই আমি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হই।”
সাদ ইবনে আবী ওয়াককাস (রা)-এর জীবন আমাদের সামনে এক অনবদ্য প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে—যেখানে আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস, অদম্য সাহস এবং দ্বীনের পথে অপরিসীম সংগ্রাম মানুষকে এক উঁচু স্তরে পৌঁছে দেয়। তাঁর বীরত্ব আর নেতৃত্ব শুধু ইসলামের সোনালি অতীতের জন্য নয়, আজও প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে সাহসের বাতিঘর হয়ে জ্বলছে। আল্লাহর ওপর নিখুঁত আস্থা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক প্রিয়তম সঙ্গী, এক অনুপ্রেরণার মূর্ত প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের শেখায়, কীভাবে সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে সত্যের পথে নিবেদিতপ্রাণ থাকা যায়।
ফুটনোটঃ
১. সূরা আনকাবুত: আয়াত ৮