রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “কেউ যদি জীবিত অবস্থায় একজন শ হি দ কে দেখতে চায়, তবে সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে।” এই দীপ্তিময় বক্তব্যের কারণেই তিনি ‘জীবন্ত শ হি দ’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। উহুদের সেই ঐতিহাসিক যু দ্ধে তালহা (রা.)-এর বীরত্ব ছিল অতুলনীয়। আবু বকর (রা.) যখনই উহুদ যু দ্ধে র স্মৃতিচারণ করতেন, তিনি বলতেন, “সেই দিনটি ছিল তালহার জন্য নিবেদিত।” তালহা (রা.)-এর প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অগাধ ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি এতটাই গভীর ছিল যে, তাঁকে জীবিত অবস্থাতেই জান্নাতুল ফেরদাউসের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। তাঁর জীবন যেন ছিল সাহস, আত্মত্যাগ ও ইমানের এক মহিমান্বিত প্রতিচ্ছবি, যা আজও মুসলিম উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করে।
ইসলামের সূচনাপর্বে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি নবীজি ﷺ-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আবু বাকর (রা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামের পথে আসা চতুর্থ ব্যক্তি। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর মা ভীষণ রাগান্বিত হয়ে ওঠেন, কারণ তাঁর ইচ্ছা ছিল তালহা গোত্রের নেতা হবেন। কিন্তু ইসলামের পথে আসার কারণে তিনি পরিবারের কঠিন বিরোধিতার সম্মুখীন হন। প্রিয়জনদের নি র্যা ত ন ও জবরদস্তি সত্ত্বেও তালহা (রা.) পাহাড়ের মতো দৃঢ়ভাবে নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন। মক্কায় দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি ধৈর্য সহকারে ইসলামের দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যান, কখনো পিছপা হননি।
ধনী ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তালহা (রা.)-এর হৃদয়ে ধন-সম্পদের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। তালহা (রা)-এর অন্যতম গুণ ছিলো, তিনি প্রচুর দান করতেন। সম্পদ জমা করা তিনি পছন্দ করতেন না। তাই তাকে বলা হতো “দানশীল তালহা”। একবার ‘হাদরামাউত’ থেকে তার কাছে প্রায় সত্তর হাজার দিরহাম এলো। এত গুলো টাকা পেয়ে তিনি সেই রাতে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এত ধন-সম্পদ ঘরে রেখে কেমন করে একজন মুমিন আল্লাহর সামনে শান্তিতে থাকতে পারে?” তিনি পরের দিনই সমস্ত টাকা দান করে দিলেন। একবার এক লোক এসে তার কাছে সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে নিজের জমি বিক্রি করে ৩ লাখ দিরহাম দান করলেন।
বদর যু দ্ধে মদিনা আক্রমণের জন্য যখন কা ফি ররা ষড়যন্ত্র আঁটছিল তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ সেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য তালহা (রা)-কে পাঠান। যদিও তিনি সরাসরি যু দ্ধে অংশ নেননি, তবুও বদরী সাহাবীর মর্যাদা অর্জন করেন। উহুদ যু দ্ধে তাঁর অসামান্য সাহসিকতা শতাব্দীর বীরগাঁথাগুলোকেও ম্লান করে দেয়। রাসূল ﷺ-এর সুরক্ষায় তিনি এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কা ফি রদের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করেন। সেই যু দ্ধে তাঁর একটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সারা দেহে ত র বারি, তীর-বর্শার সত্তরটিরও বেশি আঘাত লাগে।
খন্দক খননের সময়েও পেশীবল ও মানসিক দৃঢ়তায় তালহা (রা) সামনের সারিতে ছিলেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত ভরসা ছিল একমাত্র আল্লাহর ওপর। তিনি বলতেন, “যারা নিজেদের শক্তি ও বাহুবলের উপর নির্ভর করেছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে।” প্রতিটি যু দ্ধ ও অভিযানে তিনি রাসূল ﷺ-এর পাশে থেকে নিজের মেধা, যোগ্যতা, সাহসিকতা এবং পেশীশক্তি দিয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তবুও বিনয়ে রবের সামনে নত ছিলেন সর্বদা। অথচ আজ ক্ষণিকের সাফল্যে আমরা আত্মতুষ্টির ভারে নত হই, বিস্মৃত হই সেই পরম করুণাময়ের অনুগ্রহ, যার সীমাহীন রহমতের ঝর্ণাধারার ফলেই লাভ করেছি যাবতীয় অর্জন।
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে তালহা (রা) ছিলেন তাঁর বিশেষ উপদেষ্টা। চিন্তা, পরামর্শ এবং কাজের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে তিনি খলিফাকে সহযোগিতা করতেন। রিদ্দার যু দ্ধে র সময়, তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “যে দ্বীনে যাকাত থাকবে না, তা কখনো সত্য ও সঠিক হতে পারে না।” শরীয়াহর বিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তিনি কোমলতার পরিবর্তে দৃঢ়তা ও কঠোরতার প্রয়োগে সোচ্চার ছিলেন।
একইভাবে, দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা) তাঁর পরামর্শ নিয়েই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। উমর (রা) মৃত্যুর পূর্বে, যে ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্য থেকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত করার জন্য নির্দিষ্ট করেন, তাঁদের একজন ছিলেন তালহা (রা)। কিন্তু আত্মত্যাগের চরম উদাহরণ স্থাপন করে, তিনি খিলাফতের দাবি থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান এবং উসমান (রা)-এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজের ভোট প্রদান করেন। উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর এই অসামান্য আত্মত্যাগ আজও ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কবে সেই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উম্মাহর কল্যাণে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে শিখব?
তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.)-এর জীবন আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা; যা বিশ্বাস, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের পথ দেখায়। তাঁর উদারতা, বীরত্ব এবং বিনয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃত সফলতা দুনিয়ার বাহ্যিক প্রাপ্তিতে নয়, বরং আল্লাহর পথে সম্পূর্ণ সমর্পণেই নিহিত। তালহার (রা.)-এর জীবনী থেকে আমরা নতুন রূপে চিনতে শিখি, ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কীভাবে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত করা যায়। তাঁর জীবন আমাদের প্রতিনিয়ত আহ্বান জানায়—আমরা কি সেই আত্মত্যাগ, বিনয় ও আল্লাহর প্রতি পরম ভরসার শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে ধারণ করতে প্রস্তুত?