আবু বকর সিদ্দিক (রা.)

সিরাতের পাতায় ডুব দিলে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যার বিশ্বস্ততা ও দানশীলতার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্বের এক অনুপম মাত্রা; সেই পরম প্রিয়তম সাথী সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ” আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান (সদ্ব্যবহার) পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বাকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন।” আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দুনিয়াতেই তার জন্য ঘোষণা এসেছিল জান্নাতের। কিন্তু কি ছিল তার জীবনে, যার জন্য দুনিয়াতেই পেয়ে গিয়েছিলেন জান্নাতের অমিয় সুধা?
সর্বপ্রথম ইমান আনয়নকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। বিনা দ্বিধায় নবুয়াতের প্রতি ইমান আনেন তিনি। রাসূল ﷺ বলেন, “আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বাকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।” তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি এমন একাগ্রচিত্তে বিশ্বাস স্থাপন সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিল অনন্য; যা বর্তমান যুগেও খুঁজে পাওয়া বিরল।
ইমান আনয়নে যেমন দৃঢ় ছিলেন, তেমনি তাওহীদের দাওয়াত প্রচারে ছিলেন অবিচল। দাওয়াতী কাজে তার একনিষ্ঠতা ছিল দুনিয়াবী স্বার্থের উর্ধ্বে। মক্কার আশেপাশে গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হজের মৌসুমে বহিরাগতদের সামনে মেলে ধরতেন ইসলামের অনুপম সৌন্দর্য। তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ও চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক ‘উসমান, যুবায়ের, ‘আব্দুর রহমান, সা’দ ও তালহার মতো ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁরাও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
ইসলামের জন্য তাঁর সীমাহীন দান আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে উজ্জীবিত করে। রাসূল ﷺ এর নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর আবু বকর (রা.) এর নিকট ছিল ৪০ হাজার দিরহাম, যার সম্পূর্ণটাই উ ৎ স র্গ করেছিলেন দ্বীন ইসলামের পথে। কুরাইশদের যে সকল দাস-দাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নি গৃ হী ত ও নি র্যা তিত হচ্ছিল, সেই সব দাস-দাসী কিনে মুক্ত করে দেন। বিলাল, খাব্বাব, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়া, সুহাইব প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাবুক যু দ্ধে সমস্ত সম্পদ রাসূল ﷺ এর হাতে তুলে দেন। “ছেলে-মেয়েদের জন্য বাড়িতে কিছু রেখেছো কি?” প্রিয় রাসূল ﷺ এর প্রশ্নে জবাব দিলেন, “তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই যথেষ্ট।” হায়! সেই দিন কবে আসবে? যেদিন আমাদের জন্যেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যথেষ্ট হবেন!
যে মানুষটা হিজরতের সময় রাসূল ﷺ এর সফর সঙ্গী হতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন, তার মৃ ত্যু খবরে ছিলেন দৃঢ় অবিচল। ওমর (রা.) কোষমুক্ত ত র বা রি হাতে নিয়ে যখন ঘোষণা করলেন, “যে বলবে রাসূল ﷺ এর ওফাত হয়েছে তাকে হ ত্যা করব।” সেই বিপর্যয়ের মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ জনতাকে প্রজ্ঞার সাথে শান্ত করেন। সমবেত জনতার সামনে ঘোষণা করেন, “যারা মুহাম্মদের ﷺ ইবাদত করতে তারা জেনে রাখ, মুহাম্মদ ﷺ মৃ ত্যু বরণ করেছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত করো তারা জেনে রাখো আল্লাহ চিরঞ্জীব- তার মৃ ত্যু নেই।” যে মানুষটাকে সারাটা জীবন এতটা ভালোবেসেছেন, প্রতি মুহূর্তে যার কাছ থেকে লাভ করেছেন স্নেহের পরশ, তাঁর মৃ ত্যুতেও ইমানি বিশ্বাসে ন্যূনতম চিড় ধরেনি। ব্যক্তিপূজাকে কখনো স্থান দেননি তাওহীদের একনিষ্ঠ ঘোষণার ওপর। কোমলতা ও কঠোরতার এমন কল্পনাতীত মেলবন্ধন মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে বিশ্বাসীদের স্মৃতির পাতায়। … ধুলোমলিন সেই পাতা উল্টিয়ে নতুন অধ্যায় সূচনা করার সময় কি এখনো আসেনি?
খ লি ফা নিযুক্ত হওয়ার পর ঘোষণা দিলেন, “আমি একজন সাধারন মানুষ। আপনাদের কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবি আমি করতে পারিনা… যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন।” সংক্ষিপ্ত এ ভাষণটি চিরকাল বিশ্বের সকল রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর জীবন-যাপন ছিল খুবই অনাড়ম্বর। খলিফা হওয়ার সত্ত্বেও মদিনার অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে জনগণের অবস্থা জানতেন, কখনওবা তাদের ব্যক্তিগত কাজও নিজ হাতে করে দিতেন। রাসূল ﷺ এর মৃ ত্যুর পর তার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো- মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে তিনি এতটা জোরদার করেন যে, মুসলমানরা স্বল্প সময়ের মধ্যে ইরান ও রোমের মতো দুই পরাশক্তির বহু অঞ্চলে বিজয়ী হয়।
আবু বাকর (রা.) এক অধ্যায়, এক ইতিহাস, বিশ্বাসীদের হৃদয়ে পরম নির্ভরতার এক নাম। সিরাতের পাতায় বিচরণ করলে তার অনুসঙ্গ আমরা উপলব্ধি করি দারুণভাবে। কখনো আমাদের মনের অজান্তেই ইচ্ছা জাগে, ইস… আমিও যদি হতে পারতাম আবু বাকর (রা.) এর মতো! সবসময় প্রিয় রাসূলের ﷺ এর সাথে থাকতাম তাঁর একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে! আজ আমরা একজন আবু বাকরের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে উপলব্ধি করছি, যিনি জনগণের দুঃখবোধ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন; একইসাথে যাবতীয় ভ্রান্তির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল বজ্রকঠোর।

লেখক: ভার্সিটিয়ান দ্বীনি পরিবার

অন্যান্য লেখা

সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা) ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারাহ’র উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকটতম সাহাবী ও বাল্যকালের একান্ত বন্ধু হিসেবে তিনি শুধু এক সঙ্গীই ছিলেন না,
প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত পুরুষ থাকে, আর এ উম্মতের জন্য সেই বিশ্বস্ততম ব্যক্তি হলো আবু উবাইদাহ,"—এই কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মুখ থেকে শুনলে আবু উবাইদাহ (রা.)-এর ব্যক্তিত্বের পূর্ণচিত্র....
সাদ (রা) ইসলামের ঘোষণা দিলে তাঁর মা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “সাদ যতক্ষণ মোহাম্মদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না দেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও.......

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉