শয়তান

মূল- খান আসিফ
অনুবাদ- ইমরান রাইহান।


শহরের বাইরে প্রশস্ত মাঠে হাজারো মানুষের ভীড়। একটু পর এখানে একজন আসার কথা। সে নিজেকে খোদা দাবী করে। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষাকৃত উচু স্থানে একটি সিংহাসন রাখা। সিংহাসনের চারপাশে রেশমি কাপড়ের ঝালর।

অপেক্ষার প্রহর ধীরে চলে। জনতার মাঝে চাপা কৌতুহল ও উতকন্ঠা। অস্বস্তিবোধ করে কেউ কেউ। অনেক অনেক পরে, উত্তর দিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসে। জনতা ফিরে তাকায় সেদিকে। চারটে সাদা আরবী ঘোড়ায় টেনে আনা গাড়ি দৃশ্যপটে উদয় হয়। ঘোড়াগুলো দ্রুত টেনে আনে গাড়িকে, ধুলো উড়তে থাকে, তার মাঝেই দেখা যায় গাড়িতে বসে আছে এক বেটে লোক। লোকটি সোনালী মুখোশ পরে আছে। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তার পেছনে দাঁড়িয়ে চার প্রহরী। সবার কোমরে তরবারী। গাড়ির ডানে বামে আরো কয়েকজন সিপাহী। জনতা সরে জায়গা করে দেয়। ভীড়ের মাঝ দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে যায় সিংহাসনের দিকে। জনতা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে। সিংহাসনের কাছে এসে গাড়ি থেমে যায়। বেটে লোকটি গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে সিংহাসনে উঠে। তার পিছু পিছু সিপাহিরাও উপরে উঠে। তারা উঠেই বেটে লোকটির সামনে সিজদায় চলে যায়। বেটে লোকটি একবার সিপাহিদের দিকে তাকায়, তারপর নিরাসক্ত ভংগিতে ডান হাত উপরে তোলে যেন সে তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছে। সিপাহীরা সেজদা থেকে মাথা তোলে, ধীরে ধীরে সরে আসে তারপর তারা বেটে লোকটির পেছনে চলে যায়। চার প্রহরী বেটে লোকটির পেছনে চলে যায়। বেটে লোকটির সাথে আসা সিপাহিরা এবার সেজদা করে। বেটে লোকটি আগের মতো ডান হাত উঁচু করে গম্ভীর কন্ঠে বলে, তোমাদের সেজদা কবুল হয়েছে। সিপাহিরা ধীরে ধীরে মাথা তোলে।

‘যারা আমার ইবাদত করে তারা নিরাপদ থাকুক’ মুখোশধারী বেটে লোকটি বলে।
সিপাহিরা জোরে স্লোগান দিয়ে উঠে। শ্লোগানের শব্দ পুরো মাঠে ছড়িয়ে যায়। ‘আপনি আমাদের খোদা, আমরা আপনার বান্দা’ সিপাহিরা বলে।
উপস্থিত জনতা হতবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
‘আমরা তোমাকে খোদা মানি না। তুমি খোদা হলে তার প্রমাণ দাও’ সামনের দিক থেকে একজন বলে উঠে।
‘অপেক্ষা করো। সূর্য অস্ত গেলেই আমার খোদায়ীর প্রমাণ দেখাবো। তোমরা আমার শক্তি টের পাবে’ বেটে লোকটি বলে।
জনতা অপেক্ষা করতে থাকে। সবার মধ্যে চাপা অস্বস্তি খেলা করছে। ধীরে ধীরে সূর্যটা পশ্চিমে হারিয়ে যায়। রোদের তেজ কমে আসে, হালকা লাল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য অস্ত যায়। ধীরে ধীরে চারপাশে আধার ঘনায়। আরো কিছু সময় পার হয়। আকাশে চাঁদ উঠে। চতুর্দশীর চাঁদ।
‘এটা তার সৃষ্টি যিনি এই পৃথিবীর শুরু থেকেই খোদা এবং শেষ দিন পর্যন্তই থাকবেন। তিনি আমাকে তার অবতার করে পাঠিয়েছেন। আমাকেও তিনি অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন’ বেটে লোকটির কন্ঠ গমগম করে উঠে।
‘তাহলে তোমার শক্তি দেখাও’ কয়েকজন বলে উঠে। অপেক্ষা করতে করতে সবাই বিরক্ত হয়ে গেছে।
‘পাহাড়ের দিকে তাকাও’ বেটে লোকটি শান্তকন্ঠে বলে।
বেটে লোকটির মঞ্চের পেছন দিকেই ছোট একটি পাহাড়। সাদা জোসনায় ভেসে যাচ্ছে পাহাড়। স্থির কাঠামোকে মনে হচ্ছে ভৌতিক অবয়ব। সবাই পাহাড়ের দিকে তাকায়। প্রথমে কিছুই দেখা যায় না। জনতা বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই পাহাড়ের আড়াল থেকে একটি চাঁদ উদিত হয়। চাঁদটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের কাছ থেকে সরে আসে। এই চাদকেও চতুর্দশীর চাদের মতো দেখাচ্ছে। চাঁদটি মাঠের উপর চলে আসে। চাঁদ দুটি একইরকম উজ্জ্বল।

‘এই দেখো আমার শক্তি। এই চাঁদ আমার সৃষ্টি। এটাই প্রমান আমি খোদা’ বেটে লোকটি বলে উঠে। জনতা চুপ করে থাকে। তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা একবার চাদের দিকে তাকায়, আবার মুখোশধারীর দিকে তাকায়, তাকে মনে হচ্ছে রহস্যমানব, জনতা তার চেহারা দেখতে কৌতুহলী হয়।

‘তোমরা নিজের চোখে আমার ক্ষমতা দেখলে। তোমরা যদি আমাকে খোদা মেনে নাও তাহলে আমার নিরাপত্তার চাদর তোমাদের ঘিরে রাখবে। আর যদি এর অন্যথা হয় তাহলে তোমাদের উপর একের পর এক বিপদাপদ আসতেই থাকবে’ একথা বলে মুখোশধারী উঠে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সে গাড়িতে চড়ে বসে। ঘোড়ার ছুটন্ত পদশব্দের সাথে তার গাড়িও চোখের আড়ালে হারিয়ে যায়।
জনতা কিছুক্ষণ নির্বাক বসে থাকে। এখনো তারা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।
‘সে অবশ্যই খোদার অবতার। না হলে সে কীভাবে চাঁদ সৃষ্টি করলো?’ কেউ কেউ বলে উঠে।
‘সে জাদুকর। জাদু দেখাচ্ছে। তার কথায় বিশ্বাস করো না’ অন্যরা প্রতিবাদ জানায়। সেরাতে শহরবাসী ঘরে ফেরে দ্বিধা ও সংশয় নিয়ে।

#
পরবর্তী কদিন দেখা গেল প্রতিরাতে এই নতুন চাঁদটি উদয় হয়। ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থেমে যায়। অনেকেই মুখোশধারীর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করতে থাকে। কয়েকজন সাহসী মানুষ রাতের বেলা সেই মাঠে থেকে নতুন চাদটি পর্যবেক্ষন করে। তারা লক্ষ্য করে আসল চাদের সাথে মুখোশধারীর চাদের পার্থক্য হলো এই চাদটি পাহাড়ের ওপাশ থেকে উদিত হয়। আকাশের একটা নির্দিষ্ট অংশে এসে স্থির হয়ে যায়। রাতের শেষভাগে আবার ধীরে ধীরে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যায়।

‘এ কেমন চাঁদ? এই চাদের আকার সবসময় একই থাকে। বাড়ে কিংবা কমে না কেনো? আর কেনই বা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে এই চাঁদ থেমে যায়? এই চাঁদ কেনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় না?’ লোকেরা মুখোশধারীকে এমন নানা প্রশ্ন করে। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে সে শান্তস্বরে জবাব দেয়,

‘দেখো আসমানে যে খোদা আছেন আমি সে নই। আমি তার সহকারী। আমাকে এটুকু ক্ষমতাই দেয়া হয়েছে। যদি আমার ক্ষমতার উপর তোমাদের আস্থা না থাকে তাহলে যাও, আমার মতো এমন কাউকে খুজে নাও। দেখি পাও কিনা’
তার কথা শুনে কেউ কেউ তাকে খোদার আসনে বসায়। কেউ কেউ ভাবে সে জাদুর খেল দেখাচ্ছে।
‘এটা যদি জাদু হয় তাহলে আরেকজন জাদুকর খুজে বের করো। এমন কাউকেই তোমরা পাবে না’ মুখোশধারী রাগতস্বরে বলে। কেউ এর চেয়ে বেশি প্রশ্ন করলে মুখোশধারীর প্রহরীরা তাদের উপর হামলে পড়ে।
‘খোদার সাথে বেয়াদবি? তার অপমান করছো? অবশ্যই তোমাদেরকে এর শাস্তি ভোগ করতে হবে’ একথা বলে তারা মারধর করে। দুয়েকজন তো আঘাতের চোটে মারাই যায়। ধীরে ধীরে মুখোশধারীর বিরোধিরা জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে চুপ হয়ে যায়। তার ভক্তরা অবশ্য তাকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়। কেউ কেউ উদ্যোগী হয় নতুন চাদের রহস্য ভেদ করতে। পাহাড়ের পেছন দিকটায় গেলে এই নতুন চাদের রহস্য জানা যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যাওয়া সহজ নয়। জায়গাটা দুর্গম এবং সেখানে মুখোশধারীর সিপাহিরা পাহারা দেয়। অচেনা কেউ সেদিকে গেলেই তাকে ধরে ফেলে। তাদেরকে ভয় ভীতি দেখানো হয়। যে কয়েকজন সেদিকে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে চুপ হয়ে যায়। আর সেদিকে যাওয়ার নাম নেয় না।
এই মুখোশধারী হলো হেকিম মুকান্না খোরাসানী। ভেলকি দেখিয়ে সে দূর্বল ঈমানের লোকদের ঈমান কিনতে চায়।

#
হেকিম মুকান্না খোরাসানির জন্ম মার্ভের কাছাকাছি একটি শহরে। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন তার বংশীয় নাম হিশাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন তার নাম আতা। তার বাবা ও দাদা ছিলেন ধোপা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে অবহেলিত। এমনই এক পরিবারে আতার জন্ম। বাল্যকালেই তার এক চোখ নষ্ট হয়ে যায়। শারিরিকভাবে সে ছিল খর্বাকৃতি। ছয় সাত বছর বয়স থেকে আতা টের পায় সমবয়সীদের চোখে সে অবহেলিত। সে তাদের সাথে খেলতে চায়, কিন্তু কেউ তাকে খেলায় নেয় না। এমনকি সে তাদের কাছে গেলেও তারা সহ্য করে না।
‘কানা আসছে। তাকে সরিয়ে দাও। সে আমাদের জন্য কুলক্ষণ ডেকে আনবে’ এই কথা বলে বালকরা তাকে মারধোর করে সরিয়ে দেয়। সমবয়সীদের অবহেলা আতাকে ব্যথিত করে। ধীরে ধীরে সে সবাইকে এড়িয়ে চলতে থাকে। বাড়ির পেছন দিকে নির্জন জায়গা হয়ে উঠে তার আশ্রয়। সে একাকী বসে ভাবতে থাকে সমবয়সীদের অবহেলার কথা।
‘সময় আসুক। তোমরা ঠিকই টের পাবে আমি কে ? আজ তোমরা আমাকে লাঞ্চিত করছো। একদিন আমি তোমাদের লাঞ্চিত করবো’ ক্রোধে মুষ্ঠি বন্ধ করতে করতে বিড়বিড় করে আতা। বাল্যকাল থেকেই আতার মনে এই কষ্টকর স্মৃতি গেথে যায়। জন্মগতভাবে আতা ছিল প্রচন্ড মেধাবী। ছোটবেলাতেই সে পিতাকে এমনসব প্রশ্ন করতো যা তার বয়সি ছেলের সাথে মানায় না। মূর্খ ধোপা ছেলের এসব প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে ধমকাতো।
‘এসব আজগুবি প্রশ্ন তোমার মাথায় কোথেকে আসে? এসব বেহুদা চিন্তা বাদ দিয়ে ঘাটে যাও। কাপড় ধোও। আমাদের পেশায় কিছুটা উন্নতি করতে পারবে’ পিতা বলে।
‘ধোপার পেশা খুবই নিচু পেশা। এই পেশার কারনে কেউ আমাদের সম্মান করে না’ আতা পিতার মুখের উপর বলে দিতো।
‘ধোপার ছেলে ধোপা হয়, অন্যকিছু হতে পারে না’
‘আমি ধোপার ছেলে হবো না, আমি বাদশাহর চেয়েও বড় কিছু হবো’ আতা প্রতিবার দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতো। পিতা কখনো কখনো একে শিশুসুলভ চিন্তা ভেবে ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু আতার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার এই বিশ্বাস পোক্ত হয়। কয়েকবার পিতা তাকে মারধোরও করেন, ‘তুই নিজের চেহারা দেখেছিস? বাদশাহদের চেহারা এমন হয়’? পিতার মারধোর ও তিরস্কারের জবাবে আতার মুখে একটি বাক্যই উচ্চারিত হতো, ‘আমি বাদশাহদের চেয়েও বড় হবো’। পিতা তাকে ঘাটে নিয়ে যেতেন তবে আতা সুযোগ পেলেই পালিয়ে যেত। সে বিভিন্ন মক্তব ও দরসগাহে ঘুরে বেড়াতো। শিক্ষকদের বলতো আমি জ্ঞান অর্জন করতে চাই কিন্তু পিতা আমাকে পড়তে দেয় না। আপনারা আমাকে সুযোগ দিন। এভাবে সে বিভিন্ন মক্তবে পরতে বসে। শীঘ্রই শিক্ষকরা তার বিস্ময়কর মেধার পরিচয় পান। সমবয়সীদের তুলনায় তার মেধা ও স্মরনশক্তি অনেক বেশি। সে একবার কিছু শুনলে আর ভুলে না। উস্তাদরাও যত্নের সাথে তাকে পড়াতে থাকেন। আতার পিতা কয়েকবার শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেন, আমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সে আমাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে আপনাদের মত হতে চায়, তাকে একটু বুঝান।
‘আপনি ভুল বুঝছেন। সে পাগল হয়নি। তার মেধা খুবই প্রখর। সে পড়ালেখা করে অনেক বড় বিদ্বান হবে। সেদিন আপনাদের আর অভাব থাকবে না। সবাই আপনাদের সম্মান করবে। তাকে লেখাপড়া করতে দিন’ একথা বলে শিক্ষকরা আতার পিতাকে বিদায় করেন। পিতা হতাশ হয়ে তাকে তার মতো চলতে দেন।

#
আতা বেশিরভাগ সময় দরসগাহে অবস্থান করে। রাতের বেলা কুপি জ্বেলে দুষ্প্রাপ্য বইপত্র পড়তে থাকে। কোনো বিষয় তার কাছে অস্পষ্ট মনে হলে বারবার পড়ে, উস্তাদদের সাথে আলোচনা করে, বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার আগে সে ক্ষান্ত হয় না। উস্তাদরা জানে আতা মেধাবি ছাত্র, জ্ঞান অন্বেষনে তার প্রবল পিপাসা। কেউ টের পায় না আতার মনের গোপন কুঠুরিতে ঠিক কী লুকিয়ে আছে। পচিশ বছর বয়সে আতার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ হয়। ততদিনে সে চিকিতসা ও দর্শনে দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। দূর দুরান্তে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। সে একটি ওষুধ আবিস্কার করে যা খেলে বৃদ্ধরাও শরীরে যুবকদের মতো শক্তি অনুভব করে। এই ওষুধের কথা জানতে পেরে দূরদুরান্ত থেকে লোকজন এসে এই ওষুধ কিনতে থাকে। ধনী ও আমীরদের চাকররা এসে আতার গৃহে ধর্না দেয়। অল্পকদিনেই আতার পরিবার ধনী হয়ে যায়। আতার পিতা তাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে দিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে থাকে।


খোরাসান ও আশপাশের শহরে আতার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন তার কাছে আসতে থাকে। সবাই আতার কাছে আসতো ঠিকই কিন্তু কিন্তু মনে মনে তাকে ঘৃণা করতো। তার খর্বাকৃতি দেহ, এক চোখ নষ্ট ও কুচকুচে কালো ত্বক কোনো এক অজানা কারনে তার সাথে অন্যদের দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতো। লোকজন তাকে আড়ালে আবডালে কানা হেকিম বলতো। আতার কানে এ কথা পৌছলে সে খুব কষ্ট পায়। সে ভাবতে থাকে কীভাবে মানুষের অবহেলা ও বিদ্রুপ থেকে বাচা যায়। আতা চেহারা সুন্দর করার উপায় নিয়ে ভাবতে থাকে। সে কিছু ওষুধ তৈরী করে কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হয় না। শেষ উপায় হিসেবে সে একটি বুদ্ধি বের করে। সাত আট দিনের জন্য সে ঘরে আশ্রয় নেয়। এসময় সে কারো সাথেই দেখা করেনি।
‘হেকিম সাহেব আধ্যাত্মিক সাধনায় আছেন। কাউকে দেখা দিবেন না’ আতার কর্মচারীরা এই বলে দর্শনার্থীদের বিদায় দেয়।
আটদিন পর আতা ঘর থেকে বের হয়। তার চেহারায় সোনালী মুখোশ। মুখোশের গায়ে সুক্ষ্ম কারুকাজ। আতার কদাকার চেহারা হারিয়ে গেছে মুখোশের আড়ালে। পরের কটা দিন লোকেরা আবিস্কার করলো অন্য আতাকে। আতার চেহারার কদার্যতা আর ভাবায় না কাউকে। তার চেহারায় সোনালী মুখোশ। চোখ ও নাকের জায়গায় ছোট্ট ছিদ্র। আরবীতে মুখোশ পরিহিতদের বলা হয় মুকান্না। ধীরে ধীরে আতাকে সবাই মুকান্না নামে ডাকতে থাকে। এই নামের আড়ালে চাপা পড়ে যায় আতা ও হিশাম নামদ্বয়। পরবর্তী বছরগুলোতে মানুষ তাকে চেনে হেকিম মুকান্না আল খোরাসানি নামে, যে নামের সাথে একইসাথে মিশে আছে ঘৃণা ও বিস্ময়।
#
মুকান্নার মনে আছে তার বাল্যকালের কথা। সমবয়সীদের অবহেলা, পথিকের চোখে ঘৃণা, সবই মনে আছে। পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখন তার অনেক ভক্তও জুটে গেছে। কিন্তু মুকান্না এতেই সন্তুষ্ট নয়। সে আরো বেশি কিছু চায়। বাল্যকালে সে পিতাকে বলতো, আমি বাদশাহর চেয়েও বড় হবো। সেকথা এখনো সে ভুলেনি। তাকে অনেক বড় হতে হবে, বাদশাহর চেয়েও বড়।
মুকান্না পুনর্জন্মবাদ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিল। হিন্দুদের অনেকে এই মতবাদে বিশ্বাস করে। এই মতবাদ অনুসারে আত্মা চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর। কেউ একবার মারা গেলে আবার সে নতুনভাবে জন্মলাভ করে। আগের জন্মে পূন্য করলে পরের জন্মে সে সুন্দর মানুষের মতো জন্মগ্রহন করবে। আর আগের জন্মে পাপ করলে সে পশুপাখি হয়ে জন্মগ্রহন করবে। মুকান্না এই মতবাদকে তার কাজে লাগায়। সে তার সহচরদের বলে, আমি তোমাদের একটি বিশেষ খবর শুনাবো। আমার কথামতো চললে তোমরা সুখে থাকবে। শহরবাসীকে আমার ঘরে আসতে বলো।
এক বিশেষ দিনে মুকান্নার গৃহের সামনে অনেকেই ভীড় করে। দিনটি ছিল আলোকজ্জ্বল। মুকান্নার মুখোশে রোদ ঝলমল করছে।
‘আমি তোমার একটি বিশেষ সংবাদ দিতে চাই। আমার কথা তোমাদের কাছে নতুন মনে হতে পারে। বিশ্বাস রাখো আমার উপর, আমি মিথ্যা বলছি না। আমি পৃথিবীতে স্রষ্টার অবতার। তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে নিজের অবতার পাঠিয়েছেন। আমিও এমনই একজন’ মুকান্না ধীর কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে।
‘তোমার এই কথার প্রমাণ কী?’ একজন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে।
‘খোদা প্রথমে আদম (আ) কে তার অবতার বানান। এজন্যই ফেরেশতাদের বলেছিলেন তাকে সেজদা করতে। ইবলিস তাকে সেজদা না করায় বিতাড়িত হয়। কারন আদম (আ) ছিলেন স্রস্টার অবতার। এভাবে অন্যান্য নবীরাও ছিলেন অবতার। তোমাদের এই সময়ে আমি খোদার অবতার। অর্থাৎ জমিনের খোদা। এখন আমিই তোমাদের প্রভু। তোমরা আমাকে মেনে চললে সুখের সন্ধান পাবে’
মুকান্নার কথায় অশিক্ষিত অনেকের বিশ্বাস টলে যায়। কেউ কেউ তাকে অলৌকিক কিছু দেখাতে বলে। মুকান্না দর্শন ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি জাদুবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিল। সে আমু দরিয়ার তীরে একটি কূপে একটি কৃত্রিম চাঁদ তৈরী করে লুকিয়ে রাখে। রাত হলে এই চাঁদ ধীরে ধীরে উপরে উঠতো। নির্দিষ্ট এক স্থানে এসে এই চাঁদ থেমে যেত। চাদটি ছিল চতুর্দশীর চাদের মতই উজ্জ্বল। রাতের শেষ প্রহরে এই চাঁদ আবার নেমে যেত। মুকান্নার তৈরী এই কৃত্রিম চাঁদ দেখে তার প্রচুর অনুসারী জুটে যায়। তারা তাকে খোদা বলে মেনে নেয়। খোরাসানের বাসিন্দারা ছিল মূর্তি পূজক। ইসলামের আগমনে তারা ইসলামগ্রহন করলেও অনেকে তাদের পুরনো ধর্মের বিশ্বাস থেকে বের হতে পারেনি। বিশেষত তাওহিদ সম্পর্কে তাদের পরিস্কার জানাশোনা না থাকায় তারা সহজেই মুকান্নার কথায় প্রভাবিত হয়। মুকান্নার পূর্বে আবু মুসলিম খোরাসানিও অনেককে বিভ্রান্ত করে ফেলেছিল, পরে যাকে হত্যা করা হয়। খোরাসানের মুসলিমদের ধর্মীয় জ্ঞান কম ছিল। মুকান্না এই সুযোগ গ্রহন করে।
মুকান্না তার অনুসারীদের বলতো তাকে সেজদা করতে। সে বলতো, আমি শতাব্দীকাল ধরে অবতার থাকবো। তোমরা আমাকে সেজদা করো। আমার কথা মেনে চলো।
ধীরে ধীরে তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যেই তার অনুসারীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌছে যায়।
#
হেকিম মুকান্না তার অনুসারীদের বলতো, আমি এসেছি তোমাদের সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশের মুখ দেখাতে। তোমাদের যা ইচ্ছা হয় গ্রহণ করো। যা পান করতে মন চায় পান করো।
মুকান্না তার এই দর্শন অনুসারে শুয়োর এবং মদ বৈধ করে। সে সকল প্রকার আত্মীয়তার বন্ধন অস্বীকার করে। তার মতে যে কোনো নারী যে কারো জন্য বৈধ। এর ফলে দরিদ্র ঘরের সুন্দরী মেয়েদের জীবন হয়ে উঠে বিপন্ন। ধনী ও প্রভাবশালীরা এসব মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত। কেউ মুকান্নার কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে সে বলতো, আমার অনুসারীদের জন্য আমি সবকিছু বৈধ করেছি। যারা আমাকে খোদা মেনে নিবে তাদের জন্য সবকিছু বৈধ।
মুকান্নার অনুসারীরা দিনের একটা সময় ঘরের কোনো বসে মুকান্নার চেহারা কল্পনা করতো। এটাই ছিল তাদের কথিত ইবাদত। মুকান্নার এই ধর্মমত ছিল সবচেয়ে সহজ ধর্ম। যা ইচ্ছা করা যায়। তাই দ্রুত তার অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার অনুসারীরা কখনো কখনো আবেগের আতিশয্যে বলে বসতো, প্রভু , আমাদের কে আপনার চেহারা দেখান। আমাদের অন্তর প্রশান্ত হোক।
‘বেকুবের মতো কথা বলো না। সৃষ্টি কখনো স্রষ্টার চেহারা দেখতে পারে না। আমার চেহারা দেখলে তোমরা সহ্য করতে পারবে না’ মুকান্না ক্রোধের সাথে জবাব দিত। একথা শুনে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেতো না।
মুকান্নার সশস্ত্র প্রহরীরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। কোথাও কেউ মুকান্নার বিরুদ্ধাচারন করলেই তাকে হত্যা করতো। মুকান্নার অনুসারীরা কিছু মসজিদ নির্মান করে, যদিও তারা নামাজ পড়ত না। মুকান্না আগেই বলেছে যারা তাকে মেনে নিবে তাদের জন্য নামাজ রোজা মাফ। মুকান্না নিজে শুয়রের মাংস খেতো, মদপান করতো। তার হেরেমে ছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা সুন্দরী মেয়েরা। মুকান্নার সহচররা কোথাও কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলেই তাকে নিয়ে আসতো। মুকান্না তাদেরকে নিজের হেরেমে রেখে দিতো। মুকান্নার অনেক সন্তান হয় সে যাদের নামও জানতো না। মুকান্নার হেরেমে এক মুসলিম মেয়ে ছিল যার নাম সালমা। তাকে মুকান্নার লোক অপহরন করে এনেছিল দুরের এক গ্রাম থেকে। সালমার কিছুই করার ছিল না। রাত গভীর হলে সালমা নামাজে দাড়াতো। দুহাত তুলে দোয়া করতো, হে আল্লাহ, আমাকে এই শয়তানের হাত থেকে মুক্তি দিন। তার উপর আপনার আজাব পাঠান। তাকে ধবংস করে দিন।


মুকান্নার অনুসারী বাড়তে থাকে। সে বিভিন্ন এলাকা দখল করে। চলতে থাকে তার অত্যাচার ও লুটতরাজ। এ সময় মুকান্না দাসিক নামে একটি কেল্লা নির্মান করে। কিছুদিন পরে তার মনে হয় এই কেল্লা নিরাপদ নয়। এ চিন্তা থেকে সে সিয়াম পর্বতে আরেকটি কেল্লা নির্মান করে। এই কেল্লা ছিল খুবই মজবুত। কেল্লার চারপাশে প্রশস্ত পরিখা খনন করা হয়। শত্রুপক্ষ আক্রমন করলে এই পরিখা অতিক্রম করা তাদের জন্য কঠিন হবে। কেল্লায় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যশস্য জমা করা হয় যেন দীর্ঘমেয়াদী অবরোধেও তাদের কোনো সমস্যা না হয়।
‘এখন আর আমার বিশ্বাসীদের উপর বিপদের ভয় নেই। আজ থেকে তোমরা নিরাপদ। এই কেল্লা দখল করার শক্তি কারো নেই’ মুকান্না তার অনুসারীদের বলে। কেল্লা নির্মানের পর খোরাসানের আশপাশের এলাকার মুসলমানদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। মুকান্নার সিপাহিরা প্রচুর মুসলমানকে হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের বন্দী করে। মুকান্না শীঘ্রই নিজেকে স্বাধীন শাসক ঘোষনা দেয়।
#
সময়টা ছিল উত্তাল। আব্বাসী সালতানাত তখনো নিজেদের পা মজবুত করতে পারেনি। আবু মুসলিম খোরাসানির সমস্যা সামাল দিতে না দিতেই বোখারায় অনেকে বিদ্রোহ করে। এর মধ্যে ছিল মাবিজা নামে একটি গোত্র। মুকান্নার সাথে এই গোত্রের সরদার যোগাযোগ করে। মুকান্নাকে সে খোদা না মানলেও রাজনৈতিক কারনে তার সাথে সন্ধি করে। এছাড়া কয়েকটি তুর্কি গোত্রও মুকান্নার সাথে হাত মেলায়। মুকান্না হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। তার জুলুম নির্যাতন বেড়ে যায় কয়েকগুন।
#
নির্যাতিত মুসলমানদের একটি দল বাগদাদ পৌছায়। ক্ষমতায় তখন আব্বাসী খলিফা মানসুরের পুত্র মাহদি। নির্যাতিত এই মুসলমানরা খলিফা মাহদিকে খোরাসানের অবস্থা জানায়। এই প্রথম খলিফা মাহদি খোরাসানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। এর আগে মুকান্না সম্পর্কে তার কোনো ধারনাই ছিল না। খলিফা জানতে পারলেন মুকান্না খোরাসানে একটি নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছে। একইসাথে সে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। খলিফা ক্ষিপ্ত হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এখনই মুকান্নাকে থামাতে হবে। খলিফা মুকান্নার বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরন করেন। এই বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আবু নোমান জুনাইদ ও লাইস বিন নসর। মুকান্নার একটি অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে খলিফার বাহিনীর লড়াই হয়। এই লড়াইয়ে খলিফার বাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধে লাইস বিন নসরের ভাই মুহাম্মদ বিন নসর শহীদ হন।
খলিফা দাতে দাত চেপে এই সংবাদ হজম করেন। তিনি আরেক বিখ্যাত সেনাপতি জিবরিল বিন ইয়াহইয়া কে ডেকে পাঠান।
‘কাল পর্যন্ত তোমরা কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলে। ইসলাম তোমাদেরকে এই আধার থেকে টেনে আলোর প্রাসাদে নিয়ে এসেছে। আমি জানি এখনো তোমাদের আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে যায়নি। খোরাসানের মাটিতে মুসলিম বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করা হচ্ছে। যুবক ও বৃদ্ধদের হত্যা করা হচ্ছে। নিজেকে খোদার আসনে বসিয়েছে এক দুষ্ট বামন। তুমি সেখানে যাও। চিরতরে তার রাজত্বের স্বপ্ন মুছে দাও’ খলিফা আবেগাপ্লুত কন্ঠে বললেন।
#
জিবরিল বিন ইয়াহইয়া রওনা হলেন খোরাসানের পথে। চোখেমুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। মুকান্নার অনুসারিরা বোখারায় একটি কেল্লায় অবস্থান করছিল। জিবরিল বিন ইয়াহইয়া এই কেল্লায় হামলা চালান। চার মাস লড়াইয়ের পর মুকান্নার বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুকান্নার এক হাজার সৈন্য নিহত হয়। নিজ বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনে মুকান্না থমকে যায়।
‘যারা আসছে সবাই প্রবেশের পর কেল্লার ফটক আটকে দাও। এখানে আমরা নিরাপদ’ বলে সে।
জিবরিল বিন ইয়াহইয়া পরাজিত বাহিনীকে ধাওয়া করে সিয়াম পর্বতের কেল্লায় পৌছান। এখানে পৌছে তিনি থমকে যান। পরিখা পার না হয়ে কেল্লায় আক্রমন করা যাচ্ছে না, আবার পরিখাও পার হওয়া যাচ্ছে না। জিবরিল বিন ইয়াহইয়া কেল্লা অবরোধ করলেন।
#
খলিফা খোরাসানের অভিযান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন সেনাপতি জিবরিল বিন ইয়াহইয়ার সাথে। কেল্লা অবরোধের সংবাদ শুনে তিনি আরেক সেনাপতি আবু আউনকে পাঠালেন কিন্তু তিনি এসেও কেল্লায় আক্রমনের কোন উপায় বের করতে পারলেন না। খলিফা বাধ্য হয়ে আরেক সেনাপতি মুয়াজ বিন মুসলিম কে সত্তর হাজার সৈন্যসহ পাঠালেন। মুয়াজ বিন মুসলিম তার বাহিনী নিয়ে ঝড়ের বেগে খোরাসান পৌছলেন। এই বাহিনী পাঠিয়েও খলিফা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তিনি উকবা বিন মুসলিমের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন। উকবা বিন মুসলিম দ্রুত এসে মুয়াজ বিন মুসলিমের বাহিনীর সাথে মিলিত হন। এই দুই বাহিনী একত্রে তাওয়ালিস অঞ্চলের একটি কেল্লায় আক্রমন করে, যা মুকান্নার বাহিনীর দখলে ছিল। এই যুদ্ধে মুকান্নার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুকান্না পরাজয়ের সংবাদ শুনে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়। সে বুঝতে পারে খোলা ময়দানে মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে না। সে তার বাহিনীকে কেল্লাতেই অবস্থানের নির্দেশ দেয়।
মুয়াজ বিন মুসলিম এসে অবরোধের নিয়ন্ত্রন নেন। তার সহকারী ছিলেন সাইদ বিন আমর। দূর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকদিনের মধ্যে মুয়াজ বিন মুসলিমের সাথে সাইদ বিন আমরের কথা কাটাকাটি থেকে তীব্র ঝগড়া হয়। এমনকি সাইদ বিন আমর খলিফার কাছে পত্র লিখে বলেন, যদি আমাকে একা এই অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে আমি শীঘ্রই মুকান্নার কেল্লাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো। খলিফা সাইদের কথা মেনে নেন। মুয়াজ বিন মুসলিমকে বাগদাদে তলব করা হয়। মুয়াজ বিন মুসলিম বাগদাদ ফিরে যান কিন্তু তার ছেলেকে সাইদ বিন আমরের বাহিনিতেই রেখে যান।
সাইদ বিন আমর পরিখা অতিক্রমের অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু প্রতিবারই ব্যার্থ হন। মুসলিম বাহিনী অবস্থান করছিল খোলা ময়দানে। প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে হচ্ছিল। এছাড়া মুকান্নার বাহিনী আচমকা তীর নিক্ষেপ করে অনেক মুসলমানকে হত্যা করছিল । এতকিছুর পরেও মুসলমান বাহিনী মনোবল হারায়নি। সাইদ বিন আমর নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। যেকোন মূল্যে মুকান্না কে পরাজিত করবেনই। সাইদ বিন আমর কাঠ ও লোহার কিছু সিড়ি নির্মান করে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করেন। কিন্তু এই চেষ্টা সফল হয়নি উলটো অনেকে প্রাণ হারায়। সাইদ বিন আমর খলিফাকে বিস্তারিত জানিয়ে পত্র লেখেন।
#
সেসময় ভারতবর্ষের সিন্ধ অঞ্চল ছিল আব্বাসী সালতানাতের শাসনাধীন। খলিফা মাহদি কজন কর্মচারী পাঠিয়ে সেখান থেকে প্রচুর চামড়া সংগ্রহ করেন। গরু ও ছাগলের চামড়া সাইদ বিন আমরের কাছে পাঠানো হয়। সাইদ বিন আমর এসব চামড়ায় বালু ভরে চামড়া সেলাই করে দেন। তারপর বালুভর্তি বস্তসদৃশ চামড়াগুলো পরিখাতে ফেলা হয়। পরিখার একদিক ভরে যায়। কেল্লায় হামলা চালানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। সাইদ বিন আমর এবার প্রচন্ড শক্তিতে আক্রমন করেন। কেল্লার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে মুকান্নার সেনারা গোপনে সাইদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা জানায় তারা তওবা করে মুকান্নার পক্ষত্যাগ করবে বিনিময়ে তাদেরকে জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। সাইদ এ শর্ত মেনে নেন। মুকান্নার ত্রিশ হাজার সৈন্য সাইদ বিন আমরের কাছে আত্মসমর্পন করে। মুকান্না নানাভাবে তাদের থামাতো চেয়েও সফল হয়নি।
‘তুমি যদি খোদা হতে তাহলে এখানে বসে থাকতে না। আরো আগেই মুসলিম বাহিনীকে বিপদে ফেলে ধবংস করে দিতে’ এই বলে মুকান্নার সৈন্যরা কেল্লা থেকে বের হয়ে যায়।
#
কেল্লায় শুধু মুকান্নার দু হাজার সৈন্য অবশিষ্ট থাকে। এরা ছিল তার প্রতি নিবেদিতপ্রান। কোনোভাবেই তারা পক্ষত্যাগ করবে না। মুকান্না বুঝতে পারে কেল্লার পতন আসন্ন। যেকোনো সময় বাগদাদের সৈন্যরা কেল্লায় প্রবেশ করবে। তাকেও আবু মুসলিম খোরাসানির মতো হত্যা করা হবে। মুকান্না তার অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে কেল্লার প্রাংগনে জড়ো করে। সে তেজোদীপ্ত কন্ঠে বলে,
‘এখন তোমাদের সামনে দুটো পথ খোলা। তোমরা আত্মসমর্পন করে মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাও । অথবা আমার সাথে আসমানে চলো। সেখানে তোমরা সুখে থাকবে।
‘আমরা আপনার সান্নিধ্য ছাড়া আর কিছু চাই না’ মুকান্নার অনুচররা সমস্বরে বলে উঠে ।
এরপর মুকান্না মাঠে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেয়। আগুন জ্বলে উঠলে কেল্লার মূল্যবান সব জিনিসপত্র আগুনে ফেলা হয়। ভারবাহী পশুগুলোকেও আগুনে ফেলা হয়।
‘আমি যাচ্ছি , তোমরা আমার সাথে আসো’ একথা বলে মুকান্না আগুনে ঝাপ দেয়। তার অনুচর ও হেরেমের মহিলারা তাকে অনুসরণ করে। কারো কারো মতে মুকান্না সবাইকে মদপান করিয়ে মাতাল করেছিল। তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মুকান্না কে অনুসরণ করে আগুনে ঝাপ দেয়।
মুকান্নার হেরেমের এক মেয়ে এই সময় লুকিয়ে ছিল। মুকান্না ও তার সাথীরা মারা গেলে সে কেল্লার প্রাচীরে চড়ে মুসলিম বাহিনীকে কেল্লায় প্রবেশের আহবান জানায়।
‘আপনারা ভেতরে আসুন। এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই’
মুসলিম বাহিনী কেল্লায় প্রবেশ করে। সেখানে তখন মেয়েটি ছাড়া আর কেউ ছিলো না।
এই মেয়েই ছিল সালমা, যে রাত জেগে জেগে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো।

মুকান্নার এই ফেতনা প্রায় ১৩ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৬৩ হিজরীতে মুকান্নার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ফেতনার সমাপ্তি ঘটে।

অনুবাদকের কথা
খান আসিফ তার লেখায় কোনো ইতিহাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেননি। চলুন এবার মুকান্নার ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতামত দেখে আসা যাক । প্রথমদিকের ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রায় সবাই হেকিম মুকান্না আল খোরাসানির কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ ১৬৩ হিজরীর ঘটনাবলীতে মুকান্নার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুকান্নার তৈরী এই নকল চাঁদ দুই মাসের দূরত্ব থেকেও দেখা যেত। ইবনে কাসির লিখেছেন, মুকান্না তার স্ত্রীদের বিষপান করিয়ে হত্যা করে। নিজেও বিষপান করে আত্মহত্যা করে। মুসলিম সৈন্যরা কেল্লায় প্রবেশ করে তার লাশ পায়। তারা তার মাথা কেটে খলিফার কাছে পাঠিয়ে দেয়। খলিফা তখন হালাব শহরে অবস্থান করছিলেন। (১)
ইবনে জারীর তাবারি লিখেছেন, মুকান্নার মাথা কেটে খলিফার কাছে প্রেরণ করা হয়। (২)
ইবনে খালদুন মুকান্নার সাথে লড়াইয়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, মুকান্না সোনার তৈরী একটি মুখোশ পরে থাকতো। এছাড়া তিনি মুকান্নার নকল চাঁদের কথাও উল্লেখ করেছেন। (৩)
ইবনে আসীর লিখেছেন, মুকান্না ও তার অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল আবু মুসলিম খোরাসানী আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (নাউজুবিল্লাহ)। মুকান্নার অনুসারীরা যুদ্ধের সময় বলতো হে হিশাম, আমাদের সাহায্য করো। মুকান্নার হত্যা সম্পর্কে ইবনে আসীর দুইটি বর্ননা উল্লেখ করেছেন। ১. মুকান্না বিষপানে আত্মহত্যা করে। পরে তার মাথা কেটে খলিফার কাছে প্রেরণ করা হয়। ২. মুকান্না আগুনে পুড়ে মারা যায়। (৪)
ইবনুল জাওযি লিখেছেন, মুকান্না তার হেরেমের মহিলাদের বিষপানে হত্যা করে , পরে নিজেও বিষপান করে আত্মহত্যা করে। (৫)
খান আসিফের লেখায় যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তিনি মুকান্নার খোদায়ী দাবির জন্য অনেকটাই বাল্যকালের অবহেলা ও বিদ্রুপকে দায়ী করছেন। নির্মোহ বিশ্লেষণে এই সিদ্ধান্ত অতিরিক্ত সরলীকরণ বলেই মনে হয়। মুকান্নার জীবনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম থেকেই সে আবু মুসলিম খোরাসানি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সে মনে করতো আবু মুসলিম খোরাসানী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এছাড়া ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ লিখেছেন, মুকান্না জীবনের প্রথম দিকেই রযযামিয়াদের (শিয়াদের একটি শাখা) মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। (৬) এইসব বর্ননা দ্বারা বুঝা যায়, মুকান্না বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। একইসাথে বাল্যকালের অবহেলাও তার মনে ক্রিয়াশীল ছিল।
এবার আসা যাক মুকান্নার চাঁদ প্রসংগে। ঐতিহাসিকদের যারাই চাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তারা এই চাঁদের রহস্য সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি। এই চাঁদ সম্পর্কে একটি বর্ননা পাওয়া যায় বুলদানুল খিলাফাতিশ শরকিয়্যাহ গ্রন্থে। সেখানে আছে, মুকান্না একটি কুপে পারদভর্তি থালা রেখে দেয়। সেখান থেকেই চাঁদ উঠতো (৭)। এই বর্ননা থেকে ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ অনুমান করছেন সম্ভবত চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে শূন্যে চাঁদের আকৃতি তৈরী করতো।
বিষয়টি পরিস্কার করতে চুয়েটের অধ্যাপক ড. আব্দুর রাকিব ভূইয়ার দারস্থ হই। তিনি বলেন, মূল বিষয় হলো মানুষের দৃষ্টির কোন । যেহেতু মানুষের দৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতা আছে এবং নানা কোনে নানাভাবে খেল দেখানো যায় । তাই অনেকক্ষেত্রে সামনে না থাকা জিনিস আপাতভাবে সামনে এনে মানুষকে তাক লাগানো যায় । আলোর কোন সৃষ্টি করে অথবা মানুষের দৃষ্টিসীমার কোন(এংগেল) ব্যবহার করে এই কাজ করা যায়। এই কৌশল খাটিয়েই ডেভিড কপারফিল্ড কিছু সময়ের জন্য স্টাচু অফ লিবার্টিকে মানুষের দৃষ্টিসীমার আড়ালে নিয়ে যান।

টীকা
১। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০ম খন্ড, ১৪৫,১৪৬ পৃষ্ঠা– হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির। মাকতাবাতুল মাআরিফ, বৈরুত।
২। তারীখে তাবারী, ৯ম খন্ড, ১৪৪ পৃষ্ঠা– ইবনে জারির তাবারি। দারুল মাআরিফ, মিসর।
৩। তারীখে ইবনে খালদুন, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা– আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন। দারুল ফিকর।
৪। আল কামেল ফিত তারিখ, ৫ম খন্ড, ২৩৮, ২৩২ পৃষ্ঠা– ইবনুল আসীর। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
৫। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ৮ম খন্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
৬। জামেয়া ইমাম মুহাম্মদ বিন সাউদ সাময়িকী, শাওয়াল, ১৪২০ হিজরী। হারাকাতুল মুকান্না আল খোরাসানি — ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ। ২৭৯ পৃষ্ঠা।
৭। বুলদানুল খিলাফাতিশ শরকিয়্যাহ, ৫১৩, ১৪ পৃষ্ঠা– মুআসসাসাতুর রিসালাহ।

লেখক: অনুবাদ- ইমরান রাইহান।

অন্যান্য লেখা

আল্লাহর কসম! উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনা দান করলেও তুমি আমার সেই প্রবীণ সাহাবীদের সমকক্ষ হতে পারবে না,"— রাসূলুল্লাহ ﷺ এই মহামূল্যবান বাক্যটি বলেছিলেন যখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ও......
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "কেউ যদি জীবিত অবস্থায় একজন শ হি দ কে দেখতে চায়, তবে সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে।" এই দীপ্তিময় বক্তব্যের কারণেই তিনি ‘জীবন্ত শ হি দ’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। উহুদের.....
প্রত্যেক নবীরই একজন বিশেষ অনুসারী থাকে, আর আমার অনুসারী হলো যুবাইর।” — রাসূল ﷺ-এর এই বিশেষ স্বীকৃতিই যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর স্থান ও মর্যাদার পরিচয় তুলে ধরে। তিনি ছিলেন রাসূল ﷺ-এর...........

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉