সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা) ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারাহ’র উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকটতম সাহাবী ও বাল্যকালের একান্ত বন্ধু হিসেবে তিনি শুধু এক সঙ্গীই ছিলেন না, ছিলেন ইসলামের প্রথম সূর্যালোকে দাঁড়ানো সাহসী সাহাবীদের অন্যতম। তাঁর হৃদয়েই যেন প্রথম আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর মত কঠোর ব্যক্তিত্ব-কেও ইসলামের মায়াময় পরশে নিয়ে আসে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এঁকে গিয়েছেন বিশ্বাসের অক্ষয় পদচিহ্ন, যার অনুসরণ আমাদের নিশ্চিত জান্নাতের পথ প্রদর্শন করে।
সাঈদ (রা)-এর পিতা যায়িদ ছিলেন সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন, যাঁরা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বেই তাওহীদের পবিত্র আলোতে আলোকিত হয়েছিলেন, যখন চারদিকে কুফর ও শিরকের ঘন অন্ধকার ছিল। পৌত্তলিকতার সেই যুগে তিনি মুশরিকদের দ্বারা যবেহকৃত প্রাণীর গোশত কখনো স্পর্শ করতেন না। যখন কোনো নিষ্ঠুর পিতা তার মেয়েকে জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যেত, যায়িদ তাকে বাধা দিয়ে বলতেন, “এই নিষ্পাপ প্রাণটিকে হত্যা করো না, আমি তার যাবতীয় দায়িত্ব নেব।” তিনি মেয়েটিকে নিজের স্নেহে লালন করতেন যতদিন না সে বড় হয়ে উঠত। পরে তার পিতাকে বলতেন, “যদি তুমি চাও, আমি তোমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারি; নচেৎ আমি তার যত্ন অব্যাহত রাখব।” সত্যের সন্ধানে যায়িদ সারাটি জীবন কাটিয়ে দিলেন, কিন্তু আফসোস, রাসূল ﷺ-এর সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য তার হয়নি। মৃত্যুর প্রাক্কালে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি এক গভীর দু’আ করেন, “হে আল্লাহ, আপনি যদিও আমাকে এ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে বিরত রাখবেন না।”
আল্লাহ তাআলা যায়িদের দু’আ এক অনন্য মোহনীয়তায় কবুল করলেন। নবুওয়াতের প্রথম পর্বেই সাঈদ (রা) তার সহধর্মিণী ফাতিমা বিনতে খাত্তাবের সঙ্গে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্যে ধন্য হন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তারা সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের মুখোমুখি হলেও কুরাইশদের অত্যাচার তাদের ইমানের দৃঢ়তায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তাদের যৌথ দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন উমার ইবনে খাত্তাব (রা) এর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সাঈদ (রা) যখন ইসলামের ছায়াতলে আসেন, তখন তার বয়স কেবল বিশের কোঠায়। যৌবনের সমস্ত শক্তি ও সাহস তিনি উজাড় করে দেন ইসলামের খেদমতে। এভাবে তাঁর জীবন হয়ে ওঠে তাওহীদের পতাকা সমুন্নত রাখার এক মহাকাব্য।
সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা) ছিলেন এমন এক সাহাবী, যিনি বদরের ময়দানে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে যুদ্ধের গনিমতের ভাগীদার হয়েছিলেন। তাঁর বীরত্বের দীপ্তি যেন সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ইয়ারমুকের রক্তস্নাত প্রান্তরে, যেখানে বিজয়ের পতাকা তাঁর হাতে উড়েছিল আকাশচুম্বী গর্বে। বদরের প্রান্তর ব্যতীত সকল যুদ্ধে তিনি রাসূল ﷺ-এর পাশে দাঁড়িয়ে দ্বীনের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, যার ফলে তাঁর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ সাহাবীদের মধ্যেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে উঠেছিল।
দিমাশক বিজয়ের পর আবু উবাইদা (রা) তাঁকে সেখানকার শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন, কিন্তু সাঈদ (রা)-এর হৃদয়ে ছিল জিহাদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষা। শান্তির আসনে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। আবু উবাইদা (রা)-কে চিঠিতে লিখলেন, “আপনারা যখন জিহাদের ময়দানে, আমি তখন বঞ্চিত থাকব—এমন আত্মত্যাগ আমি মেনে নিতে পারি না।” তাঁর এই অদম্য উদ্যম এবং আল্লাহর পথে আত্মনিবেদিত থাকার আকাঙ্ক্ষায় আবু উবাইদা (রা) বাধ্য হয়ে অন্য একজনকে প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেন। সাঈদ (রা) পুনরায় ফিরে আসেন জিহাদের ময়দানে, যেখানে তাঁর জীবন আল্লাহর দ্বীনের জন্য নিবেদিত হয়ে অনন্ত বীরত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, যা আমাদের সামনে চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ভাস্বর।
সাঈদ (রা) ছিলেন প্রজ্ঞার গভীরে নিমগ্ন এক আদর্শ পুরুষ। তাঁর জীবন ছিল আল্লাহর পথে নিবেদিত এক মহত্তম আলেখ্য, যা আমাদের শেখায় কীভাবে কুরআনের সুশীতল ছায়ায় নিজের জীবনকে সার্থক করে তোলা যায়। তাঁর জীবন আমাদের পথ দেখায়, আমাদের অনুপ্রাণিত করে ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উন্নীত করার। সাঈদ (রা)-এর মতো আশারায়ে মোবাশশারার দশজন সাহাবীর জীবনগল্প যেন আমাদের হৃদয়ে জ্বেলে দেয় সত্যের আলোকবাতি, যা আমাদের পথচলাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। তাঁদের জীবনের অনুসঙ্গগুলো অন্তরে ধারণ করলে, আমাদের জীবনও হয়ে উঠবে অনিন্দ্য সুন্দর—শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে পূর্ণ, আখিরাতের মুক্তির পথ দেখানো এক অমর কাব্য।
❛জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ ১০ জন❜ এই সিরিজের সমাপ্তি আমাদের অন্তরে গেঁথে দেয় এক অনন্ত শিক্ষার বার্তা—‟সত্যের পথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন গঠনই চূড়ান্ত সফলতার দিশারি।” তাঁদের জীবনচরিত আমাদের শেখায়, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহমুক্ত হয়ে যে আলোর পথে তাঁরা অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই পথই চিরন্তন প্রশান্তি ও মুক্তির সরোবর।