শাহজাদাদের খুন

মূল : গোলাম রসুল মেহের
অনুবাদ: ইমরান রাইহান

(লেখক পরিচিতি : গোলাম রসুল মেহেরের জন্ম ১৩ এপ্রিল ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে , ভারতের জলান্ধরে। জলান্ধর মিশন হাই স্কুল ও লাহোর ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন।গালিব ও ইকবাল নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জামাতে মুজাহেদিন’ ‘নকশে আজাদ’ ‘মেহের বিতী’ ‘গালিব’ ‘মাতালিবে বালে জিব্রিল’। ১৬ নভেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লাহোরে ইন্তেকাল করেন)

প্রারম্ভিকা

১৮৫৭ সালে দিল্লীর প্রতিটি ঘটনাই ছিল মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। তবে শাহজাদাদের নির্মম হত্যাকান্ড অন্যসব ঘটনার নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এমন নয় যে, শাহজাদারা খুবই যোগ্য ছিলেন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ইতিহাসে এর কোনো প্রমান মেলে না, বরং ইতিহাসের বর্ননামতে শাহজাদারা এর বিপরীত ছিলেন। তবু শাহজাদাদের হত্যকান্ড আমাদের ব্যাথিত করে কারন তারা ছিলেন নিরপরাধ।

ঘটনার ঘনঘটা

২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী জেলখানার সামনে হাডসন (১) যে নির্মম হত্যাকান্ড চালায় তা ভাবলে যে কেউ শিউরে উঠবে। এই হত্যাকান্ডের পর যেসকল শাহজাদাকে ফাসি দেয়া হয়, তারা সকলেই ছিল নির্দোষ। ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় শাহ আলম, দ্বিতীয় আকবর শাহ ও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এবং তাদের উত্তরাধীকারিদের আচলে অসহায়ত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তৈমুরী বংশের পূর্বসুরীরা যেখানে নিজেদের সাহসিকতা ও বীরত্ব দিয়ে নতুন নতুন ইতিহাস গড়েছেন, উত্তরসুরীরা সেখানে হানাদার ইংরেজদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন ছাড়া আর কোনো উপায় পায় নি।
২২ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে হুমায়ুনের সমাধী থেকে গ্রেফতার করা হয়।

সেখানে তখন তিন শাহজাদা অবস্থান করছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্র মির্জা মোঘল ও খিজির সুলতান এবং সম্রাটের নাতী মির্জা আবু বকর। বাহাদুর শাহ জাফরের গ্রেফতারীর পরেও তারা সেখানে নিশ্চিন্তে বসে ছিলেন। কোন ভরসায় তারা ময়দানে বের হয়ে লড়ার চেয়ে আত্মগোপন করে থাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে ইতিহাস নির্বাক। মির্জা মোঘল ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং সিপাহীরা বাহাদুর শাহের অবর্তমানে তাকে স্থলাভিষিক্ত করতে প্রস্তুত ছিল। মির্জা আবু বকরও একটি লড়াইয়ে অংশ নেন । মির্জা খিজির সুলতান ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির এক শাহজাদা। গালিব তাকে নিয়ে লিখেছিলেন,
‘সৃষ্টিকর্তা তোমাকে তরতাজা রাখুক,
শাহের বাগানের এই ফুলটি বড়ই চমৎকার।’
মির্জা খিজির সুলতান কবিতা লিখতেন। তিনি ও তার ভাই মির্জা ফাতহুল মুলক গালিবের শিষ্য ছিলেন।
#
হাডসন শাহজাদাদের খোজখবর জানার জন্য দু ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিল। এই দুজন হলো, এলাহী বখশ ও রজব আলি। মির্জা এলাহী বখশ বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতো। বাদশাহর নিকটাত্মীয় হওয়ার সুবাধে কেল্লায় তার অবাধ যাতায়াত ছিল এবং কেল্লার অভ্যন্তরের সকল সংবাদ সে ইংরেজদের কাছে পাঠাতো। বিদ্রোহ শুরু হলে সে যিনাত মহলকে (২) বুঝাতে চেষ্টা করে বিদ্রোহ করে লাভ নেই, ইংরেজদের সাথে সন্ধি করা ভালো হবে। পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন নথিপত্র থেকে বুঝা যায়, বিদ্রোহ চলাকালীন যিনাত মহল বেশ কয়েকবার ইংরেজদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ ধরনের প্রস্তাব মির্জা এলাহী বখশ ইংরেজদের কাছে পৌছাত।

সাইয়েদ রজব আলীর সাথে দিল্লীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উঠাবসা ছিল। তাই বিদ্রোহের শুরু থেকেই হাডসন তাকে গোয়ান্দাগিরিতে নিযুক্ত করে। তার কাজ ছিল দিল্লীতে কী ঘটছে তা জানানো। মাওলানা যাকাউল্লাহ (৩) লিখেছেন, গোয়েন্দা হওয়ার সকল যোগ্যতা তার মধ্যে ছিল। তার উপর ইংরেজদের আস্থা ছিল এবং সেও ইংরেজদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। কারো পেট থেকে কথা বের করার আশ্চর্য যোগ্যতা ছিল তার।
এই দুই ব্যক্তি হাডসনের সাথে হুমায়ুনের সমাধিতে যায়। তাদের সাথে একশো অশ্বারোহী সেনা ছিল। সমাধির সামনে পৌছে হাডসন রজব আলী ও এলাহী বখশকে ভেতরে পাঠালো। তাদের দায়িত্ব শাহজাদাদের আত্মসমর্পন করতে রাজী করানো। প্রায় দুই ঘন্টা আলাপ চললো। শাহজাদাদের সংগীরা আত্মসমর্পনের বিরোধী ছিলেন। তাদের মত ছিল বাইরে বের হয়ে ইংরেজদের সাথে মোকাবেলা করা। চুপচাপ আত্মসমর্পন করা তৈমুরী খান্দানের জন্য অবমাননাকর। সংগীরা বারবার বলছিল, চুপচাপ মরে যাওয়ার চেয় লড়ে মরা ভালো। মৃত্যুই যখন হবেই বীরের মৃত্যুই শ্রেয়।

শাহাজাদারা মির্জা এলাহী বখশ ও রজব আলীর কথায় প্রভাবিত হয়। দু ঘন্টা পর তারা আত্মসমপর্নের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
হাডসন নিজেই লিখেছে, আমি গ্রেফতারীর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। সমাধির সকল প্রবেশপথ আটকে দেয়া হয়। মির্জা এলাহী বখশ ও রজব আলীকে আগেই বলে দিয়েছি, আমি শাহাজাদাদের গ্রেফতার করার জন্য এসেছি এবং যেকোন মূল্যে তা বাস্তবায়ন করেই ছাড়বো।

শাহজাদারা অস্ত্রসমর্পন করেন। তারা প্রানভিক্ষা চাইলেও হাডসন তা কবুল করেনি। তাদের সাথে বেশকিছু তলোয়ার ও বন্দুক ছিল। সেগুলো ইংরেজ বাহিনী জমা নেয়। শাহজাদাদের হাডসনের বাহিনীর সাথে চলার আদেশ দেয়া হয়। বন্দী শাহজাদাদের নিয়ে হাডসনের বাহিনী দিল্লীর দিকে রওনা হয়। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পথ অতিক্রম করার পর হাডসন বাহিনীকে থামায়। তারা ততক্ষনে দিল্লী দরজার কাছে পৌছে গেছে। শাহজাদাদের ঘোড়া থেকে নামানো হয়। হাডসন তার সিপাহিদের লক্ষ্য করে বলে, এরাই সেই অপরাধী যারা দিল্লীতে ইংরেজ নারী শিশুদের হত্যা করেছে। মৃত্যুই তাদের একমাত্র শাস্তি। এই বলে সে বন্দুক হাতে কয়েকবার গুলি করে। তিন শাহজাদা সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ।

পরবর্তীতে হাডসন গল্প ফেদে বসেন যে, জনতার জটলা শাহজাদাদের অনুসরণ করছিল (৪)। তারা ইংরেজদের উপর হামলা করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকে না। যদি জনতা হামলা করতেই চাইতো তাহলে হুমায়ুনের সমাধি থেকে বের হওয়ার সময়ই হামলা করতো। কিংবা পথেই হামলা করতো। এমন কোনো প্রমান নেই। (৫) আর শাহজাদাদের দিক থেকে হামলার আশংকা তো অনর্থক। যারা বিন্দুমাত্র না লড়ে অস্ত্র সমর্পন করেছে পরে তারা খালি হাতে লড়বে একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মাওলানা যাকাউল্লাহর বিবরণ অনুযায়ী প্রায় একদিন শাহজাদাদের লাশ বাজারে লটকিয়ে রাখা হয়। (৬) হাডসন এবার অন্য শাহজাদাদের দিকে মনোযোগ দেয়। দিল্লীর আশপাশ থেকে আরো ২৯ শাহজাদাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, অসুস্থ সবাই ছিল। এদের বেশিরভাগই বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিলেন না। যেমন দ্বিতীয় আকবর শাহের (৭) ভাই মির্জা কায়সার। তিনি ছিলেন খুবই বৃদ্ধ। বেশিরভাগ সময় তার হুশ থাকতো না। এমনই আরেকজন শাহজাদা মির্জা মাহমুদ শাহ। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় আকবর শাহের নাতী। তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ।কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। এদের সবাইকেই নির্মমভাবে ফাসি দেয়া হয়।

মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৩ অক্টোবর বাদশাহর দুই ছেলেকে ফাসি দেয়া হয়। ১৪ অক্টোবর আরো তিন শাহজাদাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮ নভেম্বর ২৪ শাহজাদাকে ফাসি দেয়া হয়। এদের দুজন ছিল বাহাদুর শাহের ভাগনে, দুজন শ্যালক এবং অন্যরয়া ভাতিজা ও অন্যান্য আত্মীয়। এছাড়া কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা গেছে এমন শাহজাদাদের তালিকাও দীর্ঘ।
————–
১। পুরো নাম উইলিয়াম স্টিফেন রেইকস হাডসন। (১৮২১-১৮৫৮)। তিনি হুমায়ুনের সমাধি থেকে বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেফতার করেন। –অনুবাদক

২। বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রীদের একজন। কেল্লায় তিনি খুবই প্রভাবশালী ছিলেন। বিদ্রোহের পর বাহাদুর শাহ জাফরের সাথে তিনিও রেংগুনে নির্বাসিত হন। বাহাদুর শাহ জাফর মারা যান ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। সম্রাটের পাশেই রয়েছে তার সমাধি। –অনুবাদক

৩। পুরো নাম মাওলানা যাকাউল্লাহ দেহলভী। জন্ম ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। ১০ খণ্ডে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখেছেন তারীখে হিন্দুস্তান নামে। এটি একটি অসাধারণ বই। বলা যেতে পারে ফার্সিতে রচিত সকল ইতিহাস গ্রন্থের নির্যাস চলে এসেছে এ বইতে ।–অনুবাদক

৪। গবেষক আসলাম পারভেজ লিখেছেন, শাহজাদাদের গ্রেফতার করার পর জনতার একাংশ ইংরেজ বাহিনীর পিছু নেয়। তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে ইংরেজ বাহিনীকে অনুসরন করতে থাকে। (বাহাদুর শাহ জাফর, ২৫৩ পৃষ্ঠা)– অনুবাদক

৫। আগেরদিন বাহাদুর শাহ জাফর ও যিনাত মহলের গ্রেফতারীতেও জনতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সেখানে শাহজাদাদের জন্য তাদের হামলার গল্প অনেকটাই হাস্যকর। তখন সবার মানসিক অবস্থা ছিল আগে নিজেকে বাচাতে হবে। খাজা হাসান নিজামি লিখেছেন, বিদ্রোহের পরের সময়টায় দিল্লীবাসি নিজেকে বাচাতেই ব্যস্ত ছিল। বিদ্রোহী কিংবা বাদশাহর প্রতি সকল সমর্থন তারা প্রত্যাহার করে নেয়। তাদের কাজকর্মে মনে হচ্ছিল তারা শুরু থেকেই এই বিদ্রোহের বিরোধী ছিল। (মুকাদ্দামায়ে বাহাদুর শাহ, ১৬ পৃষ্ঠা) -অনুবাদক

৬। তারীখে উরুজে ইংলিশিয়া, ২২১।

৭। বাহাদুর শাহ জাফরের পিতা। দ্বিতীয় আকবর শাহের জন্ম ২২ এপ্রিল ১৭৬০, মৃত্যু ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ । শাসনকাল ১৯ নভেম্বর ১৮০৬ – ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭ । ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পর দ্বিতীয় আকবর শাহ ইংরেজদের পেনশনভোগী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ নিরাপত্তায় তিনি আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন । ইংরেজরা তাকে মাসিক এক লাখ রুপি ভাতা দিত। –অনুবাদক

লেখক: অনুবাদ: ইমরান রাইহান

অন্যান্য লেখা

নবুওয়াতের তৃতীয় বর্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন তাঁর পরিবারকে সমবেত করে বললেন, “আমি এমন এক জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আপনাদের মধ্যে কে আমার সঙ্গী হবে?” সবাই.....
প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ‘উসমান’।” রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উক্তিটির মাধ্যমেই অনুমান করা যায় উসমান (রা.) প্রিয় নবীজি ﷺ-এর কত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খাদিজা (রা.) এর আদরের দুই কন্যা রুকাইয়া.....
উমার ইবনে খাত্তাব (রা) –ইসলামের ইতিহাসে একজন অমর নায়ক, যিনি ছিলেন ন্যায়ের জন্য নির্ভীক; সত্যের পথে অবিচল। তাঁর জীবনী যেন এক জীবন্ত মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে জ্বলেছে.....

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉