“প্রত্যেক নবীরই একজন বিশেষ অনুসারী থাকে, আর আমার অনুসারী হলো যুবাইর।” — রাসূল ﷺ-এর এই বিশেষ স্বীকৃতিই যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর স্থান ও মর্যাদার পরিচয় তুলে ধরে। তিনি ছিলেন রাসূল ﷺ-এর একান্ত সঙ্গী ও নির্ভরযোগ্য সহচর, যিনি সারাজীবন দ্বীন ইসলামের পথে অটল থেকেছেন। রাসূল ﷺ-এর নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীর গভীর প্রতিফলন যুবাইর (রা.)-এর জীবনেও দেখা গেছে দারুণভাবে। তিনি লাভ করেছিলেন “হাওয়ারিয়্যু রাসূলিল্লাহ” বা নবীর বিশেষ সহচর উপাধি।
ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই যুবাইর (রা.) ছিলেন রাসূল ﷺ-এর একনিষ্ঠ সহচর। তাঁর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যুবাইর (রা.)-এর সক্রিয় উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তখন থেকেই রাসূল ﷺ-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পর, যখন রাসূল ﷺ-কে বন্দি করার বা হ ত্যা র গুজব ছড়ায়, তখন উত্তেজিত যুবাইর (রা.) তৎক্ষণাৎ ত র বা রি উন্মুক্ত করে রাসূল ﷺ-এর কাছে উপস্থিত হন। রাসূল ﷺ তাঁর সাহসিকতায় অত্যন্ত খুশি হন এবং তাঁর জন্য বিশেষ দোয়া করেন। বলা হয়ে থাকে, এটাই ছিল ইসলামের পথে প্রথম উন্মুক্ত ত লো য়া র, যা একজন বালক নিজের জীবন উ ৎ স র্গ করতে প্রস্তুত রেখেছিল।
যুবাইর (রা.)-এর এই দুঃসাহসী ও আত্মবিশ্বাসী চরিত্র গঠনের পেছনে তাঁর মা সাফিয়্যার (রা.) অমূল্য ভূমিকা ছিল। সাফিয়্যা (রা.), যিনি ছিলেন রাসূল ﷺ-এর ফুফু, ছোটবেলা থেকেই তাঁর পুত্রকে মমতার আড়ালে কঠোর শাসনের মাধ্যমেই জীবনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। একদিন আত্মীয়রা তাঁকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিলে, তিনি বলেছিলেন, “আমি তাকে কঠোরভাবে শাসন করি, যাতে সে ভবিষ্যতে শত্রুদের পরাস্ত করতে পারে।” সাফিয়্যা (রা.) যেন আমাদের শেখান, সন্তানকে প্রকৃত সফলতা ও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে হলে, শুধু ভালোবাসাই নয়, কঠোরতাও দরকার—যা একদিন তাদের জীবনের সত্যিকার বিজয়ের পথে নিয়ে যাবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল যুবাইর ইবনে আওয়াম (রা)-এর প্রধান জীবিকা। যে ব্যবসায়ে তিনি হাত দিয়েছেন, কোনটাতেই লোকসানের মুখ দেখেননি। আল্লাহর পথে দানশীলতা ও ব্যয় করার ব্যাপারে ছিলেন সদা অগ্রগামী। সহস্রাধিক দাসদের শ্রম থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি কখনোই নিজের পরিবারে খরচ করা পছন্দ করতেন না। বরং, সবই বিলিয়ে দিতেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন সাদাসিধে, জাঁকজমকের চেয়ে সরলতা ছিল তাঁর পরিচ্ছদে। বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি নির্লোভ, সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
ময়দানে যুবাইর (রা) ছিলেন অনন্য এক যো দ্ধা। বদর যু দ্ধে তিনি এত নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সাথে লড়েছিলেন যে তাঁর ত র বা রি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল, আর শরীরে ছিল ক্ষতচিহ্নের অসংখ্য স্মৃতি। এমনই গভীর ক্ষ ত হয়েছিল যে তা চিরদিনের জন্য গর্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। পুত্র উরওয়া (রা) বলেন, “আমরা ছোটবেলায় সেই গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম।” উহুদ যু দ্ধে যখন মুসলিমদের বিজয় পরাজয়ের রূপ নেয়, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুরক্ষায় নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ১৪ জন সাহাবীর মধ্যে যুবাইর (রা) ছিলেন অন্যতম। খাইবার যু দ্ধে মৃ ত্যু র সম্মুখীন হয়েও আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে ফেরেন। মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল ﷺ-এর পতাকাবাহী ছিলেন এবং বিদায় হজের সময়ও ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী।
যদিও যুবাইর (রা) ছিলেন অসীম সাহসী, তাঁর হৃদয় ছিল শিশুদের মতো কোমল। পবিত্র কোরআনের আয়াত শুনে মোমের মতো গলে যেতেন। ইসলামের সাম্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। এমনকি দুই শ হি দ সাহাবীর মধ্যে কেউ যাতে সামান্য বেশি সম্মান না পান, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। যখন মামা হামযা (রা) এবং এক আনসারী সাহাবী শ হি দ হন, যুবাইর (রা) তাঁদের কাফনের কাপড় সমানভাবে বণ্টন করে দেন, যাতে কোনো পক্ষের প্রতি সামান্যতম বৈষম্য না হয়। সাম্যের এই দৃষ্টান্ত ইসলামের চেতনার এক উজ্জ্বল দিক।
যুবাইর (রা.) ছিলেন রাসূল ﷺ-এর সময়ের এমন এক সাহসী নায়ক, যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ইসলামের মহান আদর্শগুলো তুলে ধরেছিলেন নিজ জীবনে। তাঁর দুঃসাহসিক চরিত্র যেমন যুদ্ধে ছিল অপরাজেয়, তেমনি তাঁর কোমল হৃদয় কোরআনের প্রতিটি আয়াতের স্পর্শে হয়ে উঠত নমনীয়। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এক আলোকময় শিক্ষার প্রতিফলন, যা আমাদেরকে আল্লাহর পথে ধৈর্য, সাহস এবং নিষ্ঠার শিক্ষা দেয়।