উমার ইবনে খাত্তাব (রা) –ইসলামের ইতিহাসে একজন অমর নায়ক, যিনি ছিলেন ন্যায়ের জন্য নির্ভীক; সত্যের পথে অবিচল। তাঁর জীবনী যেন এক জীবন্ত মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে জ্বলেছে আত্মসমর্পণের আলো, সমতার আদর্শ এবং অটল বিশ্বাসের দীপ্তি। তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী নেতা, যাঁর শাসনামলে ন্যায় ও কল্যাণের জয়গান ধ্বনিত হয়েছিল মানবজাতির প্রতিটি স্তরে।
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। রাসূল ﷺ আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন, আবুল হাকাম অথবা ওমর (রা.) দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। আল্লাহ তাআলা এমন অভূতপূর্বভাবে রাসূল ﷺ এর দোয়া কবুল করেছিলেন যে, পরবর্তীতে উমার (রা.) ‘আল-ফারুক’ (ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত হন। যিনি ত র বা রি হাতে রাসূল ﷺ কে হত্যার উদ্দেশ্যে উন্মাদের মত বেরিয়ে পড়েছিলেন, পরবর্তীতে সেই ত র বা রি হাতেই সকল যু দ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সামনের সারিতে। কী কল্পনাতীত প্রত্যাবর্তন! রব চাইলে এভাবেও ফিরে আসা যায়। উমার (রা.) এর মতো আমরাও কি পারি না, তওবার ঝুম বৃষ্টিতে অতীতের সকল কালিমা ধুয়ে ফেলতে? ইসলামের জন্য সামনের সারিতে দাঁড়াতে?
ইসলাম গ্রহণের পর মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূল ﷺ এর ঘোর শত্রু আবু জাহলকে নিজেই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ﷺ এর উপর আত্মসমর্পণ করার বার্তা পৌঁছে দিলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য রূপ নেয় এবং কাবাঘরে প্রকাশ্যে সালাত আদায় করা সম্ভব হয়। অন্যরা চুপে চুপে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেও উমার (রা.) হিজরতের ঘোষণা দিলেন প্রকাশ্যে, “আমি মদিনায় চলছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্র শোক দিতে চায়, সে যেন এই উপত্যকার অপরপ্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়।” কিন্তু এ দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। উমার (রা.) এর উক্ত ঘোষণাটি যেন বইয়ের শব্দ থেকে জীবন্ত হয়ে আমাদের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। জা লি মে র বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে অনমনীয় থাকার প্রেরণা যোগায়।
হিজরতের প্রথম বর্ষ থেকে রাসূল ﷺ এর মৃ ত্যু পর্যন্ত উমার (রা.) এর কর্মজীবন ছিল রাসূল ﷺ এর কর্মময় জীবনেরই প্রতিবিম্ব। যত যু দ্ধ সংঘটিত হয়েছিল; চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল; যাবতীয় বিধি-বিধান প্রবর্তন বা ইসলাম প্রচারের যেকোনো ক্ষেত্রে উমার (রা.) এর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যু দ্ধে ই রাসূল ﷺ এর সাথে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাসূল ﷺ এর অনুপস্থিতিতে বেশ কিছু ছোট অভিযানেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বদর যু দ্ধে উমার (রা.) তাঁর আপন মামা ‘আসী ইবনে হিশামকে নিজ হাতে হ ত্যা করেন। মদ্যপানের অভিযোগে নিজপুত্রও রেহাই পায়নি শাস্তির হাত থেকে। সত্যের পথে আত্মীয় ও প্রিয়জনের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করতে পারে না; তারই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন উমার ফারুক (রা.)। আমরাও যেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি উপেক্ষা করে ইসলামকে প্রাধান্য দিতে পারি; রবের কাছে কায়মানবাক্যে এইতো আকুল প্রার্থনা।
তাবুক যু দ্ধে রাসূল ﷺ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মোট সম্পত্তির অর্ধেক ইসলামের জন্য নিবেদন করেন। খাইবারের বিজিত ভূমি বন্টন করা হলে উমার (রা.) তার ভাগের অংশটুকু আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ (প্রাপ্ত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় উ ৎ স র্গ) করে দেন; ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম ওয়াকফ। রাজকোষের অর্থের ব্যাপারে উমারের (রা) দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইয়াতিমের অর্থের মত; অর্থাৎ নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া কোন অর্থ নিতেন না রাজকোষ থেকে। অত্যন্ত সাদাসিধা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাঁর অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। রাসূল ﷺ নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় সমগ্র কুরাইশ বংশে মাত্র সতের জন লেখা-পড়া জানতেন; তাদের মধ্যে তিনি একজন। আরবি কবিতা পঠন-পাঠন ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। আরবি ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ; তাঁর সামনে ভাষার ব্যাপারে কেউ ভুল করলে শাসিয়ে দিতেন। বিশুদ্ধভাবে আরবি ভাষা শিক্ষা করাকে তিনি দ্বীনের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। আফসোস! আজ দ্বীনের এই অপরিহার্য অঙ্গকে আমরা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি? কতটুকুইবা আমাদের প্রচেষ্টা আরবি ভাষা শিক্ষার জন্য?
রাসূল ﷺ উমার (রা) এর যাবতীয় গুণাবলী লক্ষ্য করে বলেন, “আমার পরে কেউ নবী হলে তা উমারই হতো।” বস্তুত তা সম্ভব নয়! কেননা আমাদের প্রিয় রাসূল ﷺ হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন বা সর্বশেষ নবী; অর্থাৎ তারপরে আর কেউ নবী হতে পারবে না। সেই উমার (রা) যখন নবী হতে পারেননি; তখন কি আর দ্বিতীয় কারোর পক্ষে নবী দাবি করার সুযোগ থাকে?
আবু বাকর (রা) মৃ ত্যু র পূর্বে বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শক্রমে উমার (রা) কে খলিফা নিযুক্ত করে যান। উমার (রা) প্রথম খলিফা যিনি ‘আমিরুল মু’মিনীন’ (বিশ্বাসীদের নেতা) উপাধি লাভ করেন। তাঁর দশ বছরের খিলাফতকালে বহুমুখী ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করেন; যার জন্য মুসলিম উম্মাহ আজও তাঁর কাছে ঋণী। ইসলামী অনুশাসনের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলত তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্মপ্রকাশ করে। সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও ব্যাটালিয়ন নির্দিষ্টকরণ, জাতীয় রেজিস্টার বা নাগরিক তালিকা প্রণয়ন, কাজী (বিচারক) নিয়োগ ও রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কিংবদন্তির মত আজও ছড়িয়ে আছে। তাই যেন নজরুলের “উমর ফারুক” কবিতার সাথে হৃদয় আজও বিরহের সুর তোলে,
❝নাই তুমি নাই, তাই সয়ে যাই জামানার অভিশাপ,
তোমার তখ্তে বসিয়া করিছে শয়তান ইনসাফ!
মোরা “আসহাবে-কাহাফের”র মতো দিবানিশা দিই ঘুম,
“এশা”র আজান কেঁদে যায় শুধু- নিঃঝুম নিঃঝুম!❞