নবুওয়াতের তৃতীয় বর্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন তাঁর পরিবারকে সমবেত করে বললেন, “আমি এমন এক জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আপনাদের মধ্যে কে আমার সঙ্গী হবে?” সবাই নীরব। কিন্তু সেই মুহূর্তে এক কিশোরের সাহসিক কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, “যদিও আমি অল্পবয়স্ক, চোখের রোগে আক্রান্ত, দুর্বল দেহ, আমি সাহায্য করবো আপনাকে।” অসীম সাহসী এই কিশোর ছিলেন আমাদের সকলের প্রিয় আলি ইবনু আবু তালিব (রা.)। বাল্যকালেই ইমানের শক্তিশালী ভিত রচনা করেছিলেন তিনি, আর রাসূল ﷺ-এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন উন্নত চরিত্র ও মহৎ গুণাবলির শিক্ষণ।
জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি আলি (রা.)-এর একাগ্রতা ছিল অভূতপূর্ব। রাসূল ﷺ বলেছিলেন, “আমি জ্ঞানের শহর, আর আলি তার প্রবেশদ্বার।” আলি (রা.) শুধু কুরআনের হাফেজই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ তাফসিরকারকও। তাঁর বিশুদ্ধ হাদিস সংগ্রহের ব্যাপারে সতর্কতা ছিল অতুলনীয়। হাদিস গ্রহণের সময় তিনি বর্ণনাকারীকে শপথ করাতেন যেন তা একেবারে সঠিক হয়। উমার (রা.) একবার বলেছিলেন, “আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ বিচারক হলেন আলি।” এছাড়াও তিনি অসাধারণ বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন মহান বক্তা ও তৎকালীন আরবি কাব্যজগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল।
জ্ঞান সাধনার প্রতি এতটা নিবেদিত ছিলেন যে, জীবনের প্রয়োজনীয় উপার্জনে তিনি মনোনিবেশ করতে পারতেন না। জীবনব্যাপী তিনি দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেছেন, এমনকি রাসূল ﷺ-এর সময়েও ক্ষুধার কারণে পেটে পাথর বেঁধে থাকতেন। খলিফা হওয়ার পরও তাঁর অভাব ছিল প্রকট, তবুও কোন অসহায়কে খালি হাতে ফেরাতেন না। প্রয়োজনে নিজে পরিবারসহ অভুক্ত থাকতেন, কিন্তু কারো প্রয়োজন পূরণে পিছপা হতেন না।
আলি (রা)-এর জ্ঞান তাঁকে বিনয়ী করে তুলেছিল। এত উচ্চতায় পৌঁছেও তিনি কখনো জ্ঞানকে অহংকারের বাহন করেননি। তিনি নিজ হাতে গৃহস্থালীর কাজ করতেন, ভূমি কুপিয়ে ক্ষেত তৈরি করতেন, উটের রাখালি করতেন। তাঁর জীবন-যাপন এতই অনাড়ম্বর ছিল যে, প্রায়সময় শুধু মাটির উপর শুয়ে থাকতেন। এজন্য রাসূল ﷺ তাঁকে “আবু তুরাব” বা “মাটির অধিবাসী” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। আলি (রা.)-এর এই উদার, বিনম্র জীবনধারা আমাদের জন্য অসীম অনুপ্রেরণার উৎস। বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েও তিনি মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতেন।
রাসূল ﷺ-এর যুগে প্রতিটি যু দ্ধে আলি ইবনু আবু তালিব (রা.) ছিলেন সাহসিকতা ও বীরত্বের এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রাসূল ﷺ তাঁকে ‘হায়দার’ (সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং উপহার দেন ঐতিহাসিক ত র বা রি ‘যুল-ফিকার’। বদর যু দ্ধে তিনি ছিলেন নবীজি ﷺ-এর পতাকাবাহী, আর উহুদের সংকটময় মুহূর্তে, যখন মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল, আলি (রা.) ছিলেন সেই অল্প সংখ্যক মুসলিমের একজন ছিলেন, যারা জীবন দিয়ে নবীজি ﷺ-এর চারপাশে প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিলেন।
খাইবার অভিযানে আলি (রা.)-এর বীরত্ব ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। যখন অন্যরা সফল হতে ব্যর্থ হল, রাসূল ﷺ বললেন, “কাল আমি সেই বীরকে পতাকা তুলে দেবো, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয়, আর তাঁর হাতেই হবে বিজয়।” পরদিন প্রত্যাশা সবার থাকলেও, আলির (রা.)-এর ডাক পড়ল, এবং তাঁরই হাতে খাইবারের দুর্গের পতন হলো।
তাবুক অভিযানে অংশ নিতে না পারায় আলি (রা.) কিছুটা বিষণ্ণ হলেও রাসূল ﷺ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আমার জন্য সেই স্থানে আছো, যেমন হারুন মুসার জন্য ছিলেন, তবে আমার পরে কোনো নবী নেই।” নবীজি ﷺ-এর জীবদ্দশায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব আলি (রা)-এর জন্য ছিল এক অনন্য প্রাপ্তি।
খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সময় আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার ভয়ে আলি (রা.) তা প্রত্যাখ্যান করলেও, জনগণের অনুরোধে তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্ষমতার প্রতি পূর্ববর্তী তিনজন খলিফাদের মতো তিনিও ছিলেন নির্মোহ। তাঁর খিলাফতের সময় মুসলিম উম্মাহ অভ্যন্তরীণ নানা কলহের সম্মুখীন হলেও, আলি (রা.) সবসময় ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মুসলিমদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন।
আলি ইবনু আবু তালিব (রা.)-এর জীবনী এক গভীর আত্মজাগরণের আহ্বান। তাঁর সাহস, জ্ঞান ও বিনয়ের মিশ্রণ আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে ধাবিত করে। আলি (রা.)-এর শূন্যতার মধ্যে পূর্ণতা, অভাবের মধ্যে প্রাচুর্য, সংকটের মধ্যে শান্তির উদাহরণ আমাদের অল্পে তুষ্ট থাকা ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে শেখায়। তাঁর বিনয় আমাদের মাঝে প্রশ্ন রেখে যায়; আমরাও কি আমাদের জ্ঞানকে অহংকারের পরিবর্তে বাস্তবিকই কল্যাণের পথে ব্যয় করতে পারব?