আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.)

“প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত পুরুষ থাকে, আর এ উম্মতের জন্য সেই বিশ্বস্ততম ব্যক্তি হলো আবু উবাইদাহ,”—এই কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মুখ থেকে শুনলে আবু উবাইদাহ (রা.)-এর ব্যক্তিত্বের পূর্ণচিত্র ভেসে ওঠে। তাঁকে একবার দেখলেই যে কোনো হৃদয় প্রশান্তি খুঁজে পেত, তাঁর সান্নিধ্যে অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উন্মেষ হতো, আর মনে জাগতো নির্ভরতার অনুভূতি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, বিনয়, আর অসাধারণ লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর স্বভাবের অলংকার। কিন্তু সংকটের সময়ে, সেই লাজুক ব্যক্তিত্বই পরিণত হতো সিংহের মতো দৃঢ় চরিত্রে, তাঁর আত্মপ্রত্যয় যেন তরবারির ধারকে অতিক্রম করত। রাসূল ﷺ-এর ভাষায় তিনি ছিলেন ‘উম্মাতে মুহাম্মাদীর আমীন’—বিশ্বাসের প্রতীক। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ অনুসরণ করতেন, হৃদয়ে লালন করতেন তাওহীদের বীজ, যা তাঁর জন্য ফিরদাউসের চিরসবুজ বাগানে অনন্ত শান্তির প্রতিশ্রুতি বয়ে এনেছিল।
মক্কায় ইসলামের সূচনালগ্নেই আবু উবাইদাহ (রা.) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পরদিনই আল্লাহ তাঁকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। মাক্কী যুগের প্রথম ভাগে যে অল্পসংখ্যক সাহাবী ইসলামী কাঠামোর ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছিলেন, আবু উবাইদাহ (রা.) তাঁদেরই অন্যতম। মক্কার প্রতিটি তিক্ত অভিজ্ঞতা তিনি ধৈর্য সহকারে বরণ করেছেন, কুরাইশদের নির্মম নি র্যা তনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। প্রিয় মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে প্রথমে আবিসিনিয়া এবং পরবর্তীতে মদিনায় হিজরত করেছেন, শুধু ইসলামের জন্য। তাঁর প্রতিটি আত্মত্যাগ আজও আমাদের অন্তরকে আলোকিত করে, তাঁর ত্যাগের মহাকাব্য যুগে যুগে প্রেরণার অক্ষয় উৎস হয়ে চির অমলিন রয়েছে।
আবু উবাইদাহ (রা.)-এর জীবন ও সংগ্রাম প্রতিটি যুগের জন্যই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যা সাহস, ত্যাগ ও ইমানের ভাষায় অনবরত লিখিত হয়। বদর যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চ দুঃসাহসিক ঘটনাগুলোকেও ম্লান করে দেয়। মৃ ত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে, আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা নিয়ে শত্রুদের প্রতিহত করতে থাকেন তিনি। এমনকি যখন তাঁর নিজের পিতা বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে তিনি এক আঘাতে পিতার মাথা থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন করেন। এই ঘটনাটি আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্মরণীয় করে রেখেছেন: “তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ইমানদার লোকেরা তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে—তারা তাদের পিতা-ই হোক, কিংবা তাদের পুত্র, ভাই বা বংশ-পরিবারের কেউ হোক”। [১] উহুদ যুদ্ধে তাঁর রাসূল ﷺ-এর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে নবীপ্রেমের নতুন চেতনা সঞ্চার করে। তাঁর নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও বীরত্ব প্রতিটি যুদ্ধ এবং অভিযানে অনন্য ছিল। তিনি সবসময় সামনের সারিতে থেকে ইসলামের পতাকাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন।
আল্লাহর প্রতি আবু উবাইদাহ (রা.)-এর অগাধ ইমান, দ্বীনের প্রতি তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠা এবং অতুলনীয় আমানতদারিতা এমন ছিল যে, প্রখ্যাত সাহাবীরাও তাঁর প্রতি মুগ্ধ হতেন। একবার, খ্রিস্টানদের একটি প্রতিনিধি দল মীমাংসার জন্য রাসূল ﷺ-এর কাছে একজন প্রতিনিধি চাইল। রাসূল ﷺ বললেন, “সন্ধ্যায় তোমরা আমার কাছে আবার এসো। আমি তোমাদের সাথে এমন একজন দৃঢ়চেতা ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব।” উমর (রা.)-এর মতো মহান ব্যক্তিত্বও এ দায়িত্ব পাওয়ার প্রত্যাশী ছিলেন, কিন্তু রাসূল ﷺ আবু উবাইদাহ (রা.)-কে মনোনীত করেছিলেন, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি ফায়সালায় যার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
রাসূল ﷺ-এর জীবদ্দশায় যেমন তিনি ছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক, তেমনি খলিফাদের আমলেও ছিলেন তাঁদের নিকট পরম আস্থাভাজন। আবু বকর (রা.) খলিফা হওয়ার পর আবু উবাইদাহ (রা.) সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের সকল ক্ষেত্রে তাঁর সর্বোত্তম উপদেষ্টা ও সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবু বকর (রা) তাঁর শাসনামলে সিরিয়া অভিযান পরিচালনায় আবু উবাইদাহ (রা)-কে সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন, যে দায়িত্ব তিনি আস্থার সাথে সফলভাবে পালন করেন। পরবর্তীতে উমর (রা.)-এর শাসনামলেও তিনি ছিলেন সেই অনুপম বিশ্বস্ত সহযোগী, যাঁর ওপর নিরবিচ্ছিন্ন নির্ভর করা যেত।
আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা) ছিলেন তাকদিরের প্রতি অনন্য বিশ্বাসী। তিনি বিনম্রভাবে জমিনে বিচরণকারী একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইয়াতিম ও অভাবীদের প্রতি তাঁর ছিল অবারিত সহানুভূতি, আর অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল দৃঢ় ও কঠোর। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও তিনি সম্পদের মোহে ইসলামের আদর্শ ভুলে যাননি। বরং, ধন-সম্পদ নিয়ে চিন্তিত থেকে বলতেন,“আমার বাড়ি খাদেমে এবং আস্তাবল ঘোড়ায় ভরে গেছে। হায়, আমি কিভাবে রাসূল ﷺ-কে মুখ দেখাবো?” উপহার পেলে তিনি নিজের জন্য কিছুই রাখতেন না; বরং, তা জনসাধারণের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর বিনয় এতটাই মোহনীয় ছিল যে, সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে তাকে আলাদা করা যেত না। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে এক অসাধারণ ভারসাম্য ছিল, যা তাঁর জীবনযাপনে দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়।
আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা)-এর জীবনী আমাদেরকে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। তাঁর গুণাবলী যাপিত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সামনে মেলে ধরে জান্নাতের এক অবিরাম স্রোতধারা, যেখানে আমাদের শুষ্ক হৃদয় অনুপম প্রশান্তিতে সিক্ত হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর বক্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনের অমোঘ পরিণতির কথা। পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আমাদের সকলকে জীবনের নির্মোহ সত্য সম্পর্কে সতর্ক করে দেন, “কোন ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তারও একই পরিণতি হবে।” আবু উবাইদাহ (রা)-এর কথাগুলো আমাদের জীবনের অর্থ উপলব্ধিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
ফুটনোটঃ
১. সূরা-মুজাদিলা: আয়াত ২২

লেখক: ভার্সিটিয়ান দ্বীনি পরিবার

অন্যান্য লেখা

যেকোনো ভৌগলিক অঞ্চলেই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নানামুখী অস্থিরতা দেখা যায়। সাময়িক প্রশাসন শূন্যতা অনেকক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টি করে। দেশ ও জাতির কল্যাণে বিপ্লবের অর্জনকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে.....
দিল্লীর পথে হাটছিলেন পথিক। মাইলের পর মাইল নির্জন ধু ধু প্রান্তর। মাথার উপর আগুন ঝরাচ্ছে সূর্য। বইছে লু হাওয়া। দুপুরে গিয়াসপুর পৌছালেন পথিক। কবছর আগেও এখানে তেমন জনসমাগম ছিল না। কিন্তু কিছুদিন........
১৮৫৭ সালে দিল্লীর প্রতিটি ঘটনাই ছিল মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। তবে শাহজাদাদের নির্মম হত্যাকান্ড অন্যসব ঘটনার নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এমন নয় যে, শাহজাদারা খুবই যোগ্য ছিলেন কিংবা.......

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉