আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)

“আল্লাহর কসম! উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনা দান করলেও তুমি আমার সেই প্রবীণ সাহাবীদের সমকক্ষ হতে পারবে না,”— রাসূলুল্লাহ ﷺ এই মহামূল্যবান বাক্যটি বলেছিলেন যখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর মধ্যে একবার দাওয়াতি কাজের সময় মতবিরোধ হয়। তিনি খালিদ (রা)-কে স্মরণ করিয়ে দিলেন, “তুমি এমন এক সাহাবীর সাথে বিতর্কে জড়িয়েছো, যিনি ইসলাম গ্রহণের শুরুতেই সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন।” রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আমাদেরকে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর জীবন-প্রবাহ সম্পর্কে জানতে উদ্বুদ্ধ করে, যার প্রতিটি পদক্ষেপে আঁকা হয়েছে জান্নাতের অবিচল প্রতিশ্রুতি, যা তাঁকে দান করেছে ফিরদাউসের উদ্যানের অনন্ত সৌন্দর্য।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ইসলামের প্রথম পর্বেই আল্লাহর একত্ববাদের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে সত্যের পথে নিবেদন করেন। তাঁর অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ়তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর হিজরত ও আত্মত্যাগের কথা। তিনি ছিলেন “সাহিবুল হিজরাতাইন”—যিনি দুইবার হিজরত করেছিলেন, প্রথমে আবিসিনিয়া এবং পরে মদিনায়। হিজরতে তাঁর ত্যাগের এই গল্প আজও আমাদের হৃদয়ে গভীর অনুপ্রেরণা ছড়ায়। দুনিয়ার মোহ তুচ্ছ করে জীবনকে ইসলামের পথে নিবেদন করার এ অনুপম আদর্শ, আমাদেরকে আল্লাহর পথে সদা অবিচল থাকার মর্ম শেখায়।
দ্বিতীয়বার হিজরত করে মদিনায় পৌঁছানোর পর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে সাদ ইবনে রাবী (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করেন। সাদ তাঁকে নিজের সম্পত্তি ও স্ত্রীদের মধ্যে একজনকে দিতে চাইলেও আবদুর রহমান (রা.) বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন, বললেন, “আমাকে শুধু বাজার দেখিয়ে দাও।” এরপর কঠোর পরিশ্রম ও সৎ ব্যবসায়িক চিন্তাধারার মাধ্যমে তিনি স্বল্প সময়েই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। এ ঘটনা যেন আমাদের আশাহত হৃদয়কে নতুনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়, সৎ পথে ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে চললে আল্লাহ তাআলা কাউকে নিরাশ করেন না; বরং তাঁর অসীম দয়া ও রহমতের আভায় আমাদের সামনে সম্ভাবনার সুবর্ণ দুয়ার উন্মোচন করেন।
অঢেল সম্পদ অর্জন সত্ত্বেও আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর হৃদয় ছিল সম্পদের প্রতি অনাসক্ত। তাঁর ধন-সম্পদ ছিল আল্লাহর পথে দান করার একটি অনন্য মাধ্যম। তাবুক অভিযানে বিপুল পরিমাণে দান করার সময় উমর (রা.) বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন, “আবদুর রহমান, তুমি কি নিজের পরিবারের জন্য কিছুই রাখলে না?” তিনি জবাব দেন, “আমি যা দান করেছি, তার চেয়েও অধিক ও উৎকৃষ্ট জিনিস তাদের জন্য রেখেছি; আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতিশ্রুত রিযিক, কল্যাণ ও প্রতিদান।”
জীবদ্দশায় তিনি ত্রিশ হাজার দাস মুক্ত করেছেন এবং তাঁর সম্পদের অধিকাংশই আল্লাহর রাস্তায় ও সমাজকল্যাণে দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতিটি যু দ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি ইসলামের জন্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশেষ করে বদর, উহুদ ও খন্দকের মতো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা অসামান্য ছিল; উহুদ যু দ্ধে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি একত্রিশটি আঘাত গ্রহণ করেন। তাঁর এই ত্যাগ ও সাহসিকতা চিরকালীন শিক্ষার প্রতীক হয়ে আজও অম্লান রয়েছে, যা আমাদেরকে দৃঢ় সংকল্প ও অবিচলতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে।
রাসূল ﷺ-এর সাময়িক অনুপস্থিতিতে তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন। উমার (রা.) নিহত হলে, উসমান (রা.) তৃতীয় খলিফা হিসেবে ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি মুসলিমদের নেতৃত্বের দায়িত্ব ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করেন। আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে ফতোয়া ও বিচারকাজে নিযুক্ত আটজন বিশিষ্ট সাহাবীর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে উমর (রা.) তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ নিতেন। রাসূল ﷺ-এর সময় থেকেই তিনি মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা, মানুষের প্রতি উদারতা ও ইসলামকে সমুন্নত রাখার এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর প্রতিটি কাজেই আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার ছাপ ছিল স্পষ্ট। জাহেলিয়াতের যুগেও তিনি মদ পানকে হারাম মনে করতেন এবং ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধান পালন করতেন পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে।
আলী (রা.) বলেছিলেন, “তিনি আসমান ও জমিনের অন্যতম বিশ্বস্ত ব্যক্তি,” আর উমর (রা.) বলতেন, “আবদুর রহমান মুসলিমদের অন্যতম নেতা।” এত সম্মান সত্ত্বেও তিনি সর্বদা ভীত ছিলেন, বলতেন, “আমার ভয় হয়, আমাদের প্রতিদান যেন এই দুনিয়াতেই পাওয়া না হয়।” জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত এই সাহাবী নিজের অবস্থান নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকতেন। আমরা, যারা, তাঁর মতো ত্যাগের পথে অগ্রসর হতে পারিনি, সত্যিই কি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে?

লেখক: ভার্সিটিয়ান দ্বীনি পরিবার

অন্যান্য লেখা

প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ‘উসমান’।” রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উক্তিটির মাধ্যমেই অনুমান করা যায় উসমান (রা.) প্রিয় নবীজি ﷺ-এর কত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খাদিজা (রা.) এর আদরের দুই কন্যা রুকাইয়া.....
উমার ইবনে খাত্তাব (রা) –ইসলামের ইতিহাসে একজন অমর নায়ক, যিনি ছিলেন ন্যায়ের জন্য নির্ভীক; সত্যের পথে অবিচল। তাঁর জীবনী যেন এক জীবন্ত মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে জ্বলেছে.....
সিরাতের পাতায় ডুব দিলে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যার বিশ্বস্ততা ও দানশীলতার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্বের এক অনুপম মাত্রা; সেই পরম প্রিয়তম সাথী সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "....

আপনার অনুদানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে!

আপনার সদয় অনুদানের জন্য ধন্যবাদ! আপনার উপহারটি সফলভাবে পৌছে গেছে এবং আপনি শীঘ্রই একটি এসএমএস অথবা ইমেইল পাবেন।

অনুদানের তথ্য

Thank You for Registering! 🎉

Connect Us:

See you soon! 🎉